সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুলের সম্পদের পাহাড়! গড়ে তুলেছিলেন ত্রাসের রাজত্ব
- আপডেট সময় : ১২:১৭:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪
- / ৩০৪ বার পড়া হয়েছে
হাওলাতি টাকায় এমপি হয়েই আর পিছনে তাকাতে হয়নি রাজবাড়ী-২ আসনের সাবেক এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক রেলপথ মন্ত্রী মোঃ জিল্লুল হাকিম। এছাড়া মন্ত্রীর সহযোগিতায় তার পুত্র এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন।
৫ বার এমপি হয়ে নিজে ও স্ত্রী-সন্তান মিলে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় নিয়োগ, সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডার কমিশন, ঠিকাদারী কাজ, বালু উত্তোলন, জমি দখল, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান, বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করিয়ে দু’হাতে কামিয়ে হয়েছে হাজার কোটি টাকার মালিক। দেশে ও বিদেশে গড়ে তুলেছেন বাড়ী, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কয়েকবার জেলার শীর্ষ করদাতার পুরস্কারও হাতিয়ে নেন পিতা-পুত্র। তার দুঃশাসনের হাত থেকে বিএনপি-জামায়াত ইসলামী নয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও রেহাই পাননি। তার এ সকল অপকর্মের জন্য ছেলে আশিক মাহমুদ মিতুল হাকিম গড়ে তোলেন হাতুরী বাহিনী। তার বাড়ীর কাজের লোকও হয়েছে শত কোটি টাকার মালিক। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর গাঢাকা দিয়েছেন সাবেক রেলপথ মন্ত্রী জিল্লুল হাকিম ও তার পরিবারের সদস্যরা। ইতিমধ্যেই দুর্ণীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক রেলপথ মন্ত্রী জিল্লুল হাকিম, তার ছেলে আশিক মাহমুদ মিতুল হাকিম, স্ত্রী সাহিদা হাকিমকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।
তথ্যনুসন্ধানে জানাগেছে, রাজবাড়ী-২ আসন (পাংশা-বালিয়াকান্দি ও কালুখালী) থেকে জুন ১৯৯৬ সাল, ২০০৮ সাল, ২০১৪ সাল, ২০১৮ সাল, ২০২৪ সালে জিল্লুল হাকিম এমপি হন। রাজবাড়ী-২ আসনে জিল্লুল হাকিম ৬ বার নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন ৫বার এমপি হন। তিনি ১৯৯৬ সালে মাত্র ৫০ হাজার টাকা ঋণখেলাপীর কারণে মনোনয়ন বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়। একজন প্রবীন আওয়ামী লীগের নেতার কাছ থেকে হাওলাত নিয়ে তার একটি ভাঙা মোটরসাইকেল চালিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন। তারপর থেকেই আর পিছনে ফিরে তাকে হয়নি।
জিল্লুল হাকিম গড়েছেন সম্পদের পাহাড় : জিল্লুল হাকিম তার, স্ত্রী ও ছেলের নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ৫০ কোটি টাকা মুল্যের রাজধানীর উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ৮/এ নম্বর রোডে ১০ কাঠা জমির উপর সাততলা ভবন, এ বাড়ীটির সামনেই পাঁচ কাঠার আরো একটি প্লট, রাজধানীর বনানী সুপার মার্কেটের পেছনে অর্চার্ড হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট, সিঙ্গাপুরে ১৪ কোটি টাকা মূল্যের ফ্লাট ও জাপানে বাড়ী রয়েছে বলে জানাগেছে। এছাড়াও সরকারী জেলা পরিষদের ১৩ শতাংশ দখল ও ২০ শতাংশ সংখ্যালঘুদের জমি নামমাত্র মূল্যে রেজিষ্ট্রি করে পাংশা পৌর শহরের ষ্টেশন বাজারের সামনে ৩৩ শতাংশ জমির উপর তার বাবার নামে মাহমুদ প্লাজা নামে ৪ তলা মার্কেট নির্মাণ করেছেন। একই উপজেলার পার নারায়নপুর মৌজায় পারনারায়নপুর মসজিদের পাশে ২০ বিঘা জমিতে আম-বাগান বাড়ী, পাংশার নারায়নপুরে নিজের বাড়ীর সামনেই ১২ শতাংশ জমি ক্রয় করে সেখানে ৩তলা ভবন নির্মাণ কাজ করছেন। রাজবাড়ী শহরের বড়পুল এলাকায় বসুন্ধরা সিনেমা হলের ৪২ শতাংশ জমি তার স্ত্রী সাহিদা হাকিমের নামে ক্রয় করেন। ওই জমির সামনে সড়ক ও জনপথের জমি দখল করে বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণ করেছেন। ২০১২ সালে কালুখালী উপজেলা পরিষদের পাশে মহিমশাহী চাঁদপুর মৌজায় ৬ বিঘা জমি নিজের নামে ক্রয় করেছেন। বালিয়াকান্দি উপজেলার সদর ইউনিয়নের চামটা, দেওকোল মৌজায় ১২টি পরিবারের ১০৭ বিঘা জমি নামমাত্র মুল্যে রেজিষ্ট্রি করে নেন। পাশেই তালতলা এলাকায় প্রায় ৬০ বিঘা জমি সংখ্যালঘু গোবিন্দ পরিবারের উপর নির্যাতন করে আওয়ামী লীগের নেতা বারেক বিশ্বাসের নামে রেজিষ্ট্রি করে নিলেও পরে তার নিজের নামে রেজিষ্ট্রি করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার ব্যবহারের জন্য রয়েছে বিলাস বহুল টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার, প্রাডো ভি-৮, পাজেরো ভি-৬, নোয়া মাইক্রোবাস, টয়োটা মাইক্রোবাসহ ৬টি গাড়ী। এ ছাড়াও রাজবাড়ী সদর, বালিয়াকান্দি, কালুখালী, পাংশা, রাজধানী ঢাকা ও বিদেশে নামে বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
পদ্মা ও গড়াই নদী থেকে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন : পদ্মা নদীর ভাঙনে যখন মানুষ ভিটা-বাড়ী হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। সেখানে পাংশা উপজেলার চর আফড়া, কালুখালী উপজেলার গৌতমপুর, হরিণবাড়ীবাড়ীয়া এলাকার অন্তত অর্ধশতাধিক স্পটে এমপি পুত্র মিতুল হাকিম ও তার ক্যাডার তোফাজ্জেল, ফজলু মেম্বার, জনি, মারুফ সহ বেশ কয়েকজন বালু উত্তোলন করে। কালুখালীর চর পাতুরিয়া গড়াই নদীর বালু মহাল সাওরাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম আলী, মৃগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম.এ মতিনের নেতৃত্বে উত্তোলন করে বিক্রি করে। এসব স্থান থেকে প্রতিদিন ১৫-২০ লাখ টাকার বালু বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে মিতুল হাকিম ও সাহিদা হাকিম বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালে পাতুরিয়া গড়াই নদীর বালু মহাল টেন্ডার ছাড়াই দখল করে বালু উত্তোলন করে। এতে সরকার হারিয়েছে রাজস্ব।
জাপান পাঠানোর নামে প্রতারনা : জিল্লুল হাকিমের ছোট ভাই আবু নাসের হাকিম জাপানে ব্যবসা করেন। সেখানে তার বাড়ী-গাড়ী সব রয়েছে। জিল্লুল হাকিমের ছেলের মিতুল ট্রেডিংয়ের নামে শতাধিক যুবকের কাছ থেকে জাপান পাঠানোর নামে প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জিল্লুল হাকিমের বিরুদ্ধে। এসব যুবকের কাছ থেকে ট্রেনিংয়ের নামে তার কাঠাল বাগানের পুরাতন বাড়ীতে রেখে ২৫ হাজার টাকা ও জাপান পাঠানোর নামে ৪-৫ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয়। প্রথমে ৫জনকে পাঠান। পরে আরও ৫ জনকে পাঠালেও বাকীদের টাকাও ফেরত পায়নি। বারংবার টাকার জন্য তার কাছে ধর্ণা দিলেও কোন কাজ হয়নি। তবে সরকারী অর্থায়নে ফ্রি অর্থে পাঠানোর কথা ছিল।
ওই সময়ে জাপান যাওয়া একজন নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, সরকারী ভাবে জাপান পাঠানোর কথা থাকলেও জিল্লুল হাকিম আমাদের কাছ থেকে জাপানে যাওয়ার জন্য ১০-১২ লক্ষ টাকা করে নিয়েছেন। প্রথমে ৫জনকে পাঠান। পরে কয়জনকে পাঠান জানি না। তবে অনেকেই টাকা দিয়ে ফেরত পাননি।
স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় নিয়োগ বাণিজ্য : পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী উপজেলায় শতাধিক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী কাম প্রহরী পদে নিয়োগের মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জিল্লুল হাকিম ও তার স্ত্রী সাহিদা হাকিমের বিরুদ্ধে। প্রকাশ্যে দিবালোকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সভাপতি ও নিয়োগ কমিটির লোকজনকে আটকে রেখে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে নিয়োগ সম্পন্ন করে। জিল্লুল হাকিম ও তার স্ত্রী সাহিদা হাকিম বালিয়াকান্দি সরকারী কলেজ, মীর মশাররফ হোসেন কলেজ, জাহানারা বেগম কলেজ, নারুয়া লিয়াকত আলী কলেজ, বালিয়াকান্দি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় সহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সভাপতি হয়ে নিয়োগ বাণিজ্য করে প্রায় ২শতাধিক নিয়োগ প্রদান করে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ৩টি উপজেলার কোন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় জনবল নিয়োগ দিতে হলেই এমপির কথার বাইরে কারো নিয়োগ হয়নি। কথা না শুনলে বন্ধ হয়ে যেত নিয়োগ প্রক্রিয়া। তিনি বিএনপিপন্থী কিছু লোকের আওয়ামী লীগে যোগদান করার পর মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়োগ দিয়েছেন।
সরকারী নিয়োগ ও কমিশন বাণিজ্যে : ৩টি উপজেলার সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে তার মনোনীত লোক দিয়ে কমিটি, সরকারী হাসপাতাল, এলজিইডির টেন্ডার, হাট-বাজার ইজারা, খেয়াঘাট, জলমহাল ইজারা সবই জিল্লুল হাকিমের কথায় হতো। তার কথার বাইরে গেলে কেউ কাজ পেতেন না। এলজিইডির ঠিকাদারী কাজ নিতে হলে আগেই জিল্লুল হাকিমকে ১৫% কমিশন দিয়ে আসতে হতো। তার ইচ্ছা মতো পেতেন হাট-বাজার, খেয়াঘাট ও জলমহাল ইজারা। তার বাইরে গেলেই সে ভোগদখল করতে পারতেন না। এছাড়াও টিআর, কাবিখা, কাবিটা, বিশেষ বরাদ্দ, ইজিপিপি প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা কাজ না করেই হাতিয়ে নিয়েছেন। কালুখালী উপজেলায় একদিনে প্রায় ৪শতাধিক ওয়াজ মাহফিল ও নামযজ্ঞানুষ্ঠানের নামে ৪শত মেট্রিক টন চাউল জিল্লুল হাকিমের নেতৃত্বে হাতিয়ে নেওয়া হয়। ২০২৪ সালের জুনের আগেই ৩টি উপজেলাতে ৩ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দের নামে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জিল্লুল হাকিম ও তার ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। তার সময়ে কাগুজে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তার সবই পকেটস্থ করেছেন।
দলীয় নেতাকর্মী নির্যাতন : জিল্লুল হাকিম, স্থানীয় সরকার পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা সহ বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রতিক নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ, দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নিজের পছন্দের প্রার্থী ঘোষণা, পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ীসহ নানান অভিযোগ রয়েছে। রাজবাড়ী জেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি ও পাংশা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নাদের মুন্সী সহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৭ জন নেতাকর্মী খুনের ঘটনার ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জিল্লুল হাকিমের অন্ধ ভক্ত না হওয়ায় পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাসান আলী বিশ্বাস, সাবেক সভাপতি এ্যাড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর, সাবেক বন ও পরিবেশ সম্পাদক এ্যাড. ফরহাদ আহমেদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চিত্তরঞ্জন কুন্ডু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান, যুবলীগের সাবেক সভাপতি দিবালোক কুন্ডু জীবন, বাহাদুরপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মোহন মুন্সী, ছাত্রনেতা ইদ্রিস মন্ডল, বালিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন অর রশিদ, নারুয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম সহ অনেকেই পদ হারিয়েছেন। কালুখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী সাইফুল ইসলাম, সাবেক আহবায়ক মোঃ আবুল হোসেন মোল্লা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সামছুল আলম, বালিয়াকান্দির বহরপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান খান সহ অনেকেই পদবঞ্চিত হন। শুধু তাই নয় জিল্লুল হাকিমের ষড়যন্ত্রে নানা ধরণের হামলা-মামলার শিকার হন।
এছাড়াও কালুখালীর বেতবাড়ীয়া গ্রামের যুবলীগ নেতা রবিউল ইসলামকে হত্যা, পাংশার সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদকে হত্যা চেষ্টা, পাংশা উপজেলার সুবর্ণখোলা গ্রামের খলিলুর রহমান খানকে পিটিয়ে জখম করে। তার ছোট ভাই স্কুল শিক্ষক আসাদুল খানকে পিটিয়ে হত্যা করে। কালুখালী উপজেলার মোহনপুর গ্রামের ভ্যান চালক আব্দুর রহিম হত্যা, কালুখালী উপজেলার কালিকাপুরের কৃষকলীগের সহ-সভাপতি মোঃ আমজাদ, পাংশা উপজেলা যুবলীগের সদস্য আবু হাসান হাবু, মৌরাট ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত হোসেন মেম্বার, কালুখালীর সাওরাইল ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ মিয়া সহ অনেককে হত্যার নেপথ্য হিসেবে জিল্লুল হাকিম, তার ছেলে মিতুল হাকিম এবং তার ক্যাডার বাহিনীর ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় কালুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম খানকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ২ পা ভেঙে দেওয়া হয়। মদাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম মৃধা, সাওরাইলের আওয়ামী লীগ নেতা রাকিবুল ইসলাম আকমল খানকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে তার ক্যাডাররা। এ রকম শতাধিক নেতাকর্মীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া সহ হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। ৪ বারের ইউপি চেয়ারম্যান ও ৪ বারের উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদকে হঠাতে দলীয় ক্যাডার লেলিয়ে দিয়ে মারধর করাসহ তার চাচাতো ভাই এহসানুল হাকিম সাধনকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানান।
জিল্লুল ও স্ত্রীর নামে বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের ভবন : কালুখালী উপজেলার খাগজানা উচ্চ বিদ্যালয়, রতনদিয়া রজনী কান্ত উচ্চ বিদ্যালয়, মোহাম্মদ আলী একাডেমি, পাতুরিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, ধামচন্দ্রপুর উচ্চ বিদ্যালয়, কালুখালী মেধা চয়ন একাডেমি, গোপালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাংশার বহলাডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়, সরিষা প্রেমটিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাংশা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ইয়াকুব আলী বিদ্যাপীঠ,পাটিকাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়, পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজ, হাবাসপুর কে রাজ উচ্চ বিদ্যালয়, যশাই উচ্চ বিদ্যালয়, পাংশা জর্জ হাই স্কুল, পাংশা সরকারী কলেজ, বালিয়াকান্দি সরকারী কলেজ, বহরপুর কলেজ, জামালপুর কলেজের ভবন গুলো বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুল হাকিম একাডেমিক ভবন নাম করণ করা হয়েছে। পাংশার ইয়াকুব আলী বিদ্যাপীঠ বীরমুক্তিযোদ্ধা জিল্লুল হাকিম ও তার স্ত্রী সাহিদা হাকিম ভবন নামকরণ করা হয়েছে। বালিয়াকান্দি, পাংশা ও কালুখালী উপজেলার প্রায় অর্ধ শতাধিক ভবনের নাম করণ করেছেন।
মন্ত্রীর বাড়ীর কেয়ারটেকার মজনুও কোটি টাকার মালিক : রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের বাসার কেয়ারটেকার হিসেবে পরিচিত মিজানুর রহমান মজনু। বাবার তেমন কোন সম্পদ না থাকলেও দুই যুগে মন্ত্রীর বাড়ীর কেয়ারটেকার থেকে জেলা পরিষদের সদস্য হন। তারপর দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে ইউপি নির্বাচনে মন্ত্রীর প্রভাবে কালুখালীর মদাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হন। তার হাতে ৩টি উপজেলার বহু নেতাকর্মী নাজেহাল ও লাঞ্ছিত হয়েছে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, পুলিশ কনস্টেবল, বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরানো-ছাড়ানো সহ বিভিন্ন ভাবে হাতিয়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা। গড়ে তুলেছেন কোটি টাকা ব্যয়ে কালুখালীর চাঁদপুর বাসষ্ট্যান্ডে ৪তলা বিলাস বহুল ভবন, গ্রামে বিল্ডিং, মাঠে প্রায় ২০ বিঘা জমি, নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে জেলা পরিষদের যাত্রী ছাউনী ভাংচুর সহ জায়গা দখলের বিস্তর অভিযোগ। সে ছিল মিতুল হাকিমের হাতুরী বাহিনীর প্রধান।
আওয়ামী লীগ ও সহযোগি সংগঠন কুক্ষিগত : ২০২১ সালের ১৬ অক্টোবর রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও ২ মার্চ কমিটি অনুমোদিত হলেও কোন সভা হয়নি। দীর্ঘ ২৩ বছর পর জেলা আওয়ামী যুবলীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন ২০২৩ সালের ৪ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতি মোঃ শওকত হাসান এবং সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান মিয়া সোহেল ঘোষণা করা হয়। পরে পুর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। দীর্ঘ ১১ বছর পর ২০২৩ সালের ২১ জুলাই বিকেলে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতি জাকারিয়া মাসুদ রাজীব ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান চৌধুরীর নাম ঘোষণা করাসহ ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করে কেন্দ্রীয় দফতরে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে পুর্ণাঙ্গ কমিটি আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘ ১৫ বছর পর ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ রাজবাড়ী জেলা শাখার ঘোষণা করা হয়। সভাপতি হিসেবে তানিয়া সুলতানা কংকন, সহসভাপতি মেহেদি হাচিনা পারভীন, সাধারণ সম্পাদক সাদিয়া চৌধুরী তন্বী এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক হাসিনা ইসলামের নাম ঘোষণা করেন। পরে পুর্ণাঙ্গ কমিটি আলোর মুখ দেখেনি। ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ী জেলা যুব মহিলা লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতি কানিজ ফাতেমা চৈতি, সহ-সভাপতি মোছাঃ সাবিনা আক্তার, মুক্তি রানী কর, কেয়া রানী প্রামানিক, রহিমা আক্তার, প্রিয়াংকা চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা নাজমুন নাহার সেন্টি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রোমানা কবির, তামান্না নাসরিন রেশমীর নাম ঘোষণা করে। দীর্ঘ ছয় বছর পর রাজবাড়ী জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয় ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর। মোঃ শাহিন শেখকে সভাপতি ও মোঃ জাহিদুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। পরে আর পুর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হয়নি। ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারী জেলা কৃষকলীগের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। আবু বক্কর খানকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক করে ৪১ সদস্য বিশিষ্ট ৬ মাসের জন্য অনুমোদন দেন। এরপর আর সম্মেলন আলোর মুখ দেখেনি। এসব জিল্লুল হাকিমের প্রভাবে কোন কমিটি গঠন করতে পারেনি। এছাড়া জেলা আওয়ামীলীগের কমিটিতে তার মতের বাইরের দু’চারজন নেতা স্থান পাওয়ায় কমিটি ঘোষণার ২ বছরের মধ্যে জেলা কমিটির একটি সভাও তিনি করতে দেননি।
জিল্লুল ও স্ত্রী-সন্তানকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : গত ১৭ অক্টোবর দুর্ণীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের লক্ষে সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম, তার স্ত্রী সাহিদা হাকিম, ছেলে আশিক মাহমুদ মিতুল হাকিমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মোঃ জিনাত ইসলামের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ নির্দেশনা প্রদান করেন।
পাংশার নারায়নপুরের খন্দকার নজরুল ইসলামের ছেলে বিপ্লব খন্দকার বলেন, তাদের বাপ-দাদার ভোগ দখলীয় প্রায় শতবর্ষী জমিতে থাকা একটি আধুনিক মানের হোটেল প্রকাশ্যে রেলওয়ের লোকজন দিয়ে গুড়িয়ে দেয়। এর আগে রেলওয়ের লোকজন ৫ কোটি টাকা দাবী করে। পরে সাবেক রেল মন্ত্রী জিল্লুল হাকিম প্রকাশ্যে মিটিংয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেন। আরও ভাঙার ঘোষণা দিলেও রহস্যজনক কারো একটি ঘরও ভাঙেনি।
পাংশা উপজেলা সাবেক যুবলীগ নেতা দিবালোক কুণ্ডু জীবন বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরও আমাকে হত্যা চেষ্টা করা সহ মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে শেষ করে দিয়েছে। আমি বিচার দাবী করছি।
পাংশার সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমার দুই হাত, দুই পা ভেঙে ও কুপিয়ে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়। আমি হামলাকারীদের বিচার দাবি করছি।
পাংশার বন্দনা রানী বলেন, আমাদের জমি দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে দখলে নিয়েছে। শুধু তাই নয় সাবেক রেলপথ মন্ত্রীর বাসায় শাশুরীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ৩দিন পর ফেরত দেয়। পরে আবার আমাকে রাত ১২ টার সময় গম গোবিন্দের গোডাউনে নিয়ে যায়। সেখানে সাবেক রেলপথ মন্ত্রীর চাচাতো ভাই রুমি হাকিমের উপস্থিতিতে হুমকি দেয়। পরে আমাদেরকে বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করাসহ লুটপাট করে। আমরা বিচার দাবী করছি।
কালুখালীর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাকে নৌকা মার্কার মনোয়ন দেওয়া হলেও তার প্রভাবে মাঠে নামতে দেয়নি। পরে মাঠ ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। বিএনপির লোকজন দলে নিয়ে রাজবাড়ী-২ আসনে দলের অন্তত ৪২ জন নেতা-কর্মীকে নির্যাতন করাসহ হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানী করে। অনেকেই তার ভয়ে বাড়ী ছাড়া হতে হয়। অর্ন্তবতীকালীন সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর এলাকায় ফিরতে শুরু করেছেন। অবৈধ ভাবে অর্জিত সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য দুর্ণীতি দমন কমিশনের নিকট অনুরোধ জানান।
জিল্লুল হাকিম, তার ছেলে আশিক মাহমুদ মিতুল ও স্ত্রী সাহিদা হাকিম পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্যে নেওয়া সম্ভব হয়নি।