ঢাকা ০১:৪১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাসপাতাল এতো ‘এতীম’ কেন?

রাজীব দে সরকার, সার্জারী বিশেষজ্ঞ, শিশু চিকিৎসক ও সার্জন এবং কলামিস্ট
  • আপডেট সময় : ০১:০৫:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / ১০৮ বার পড়া হয়েছে

সোজা সাপটা বলে দেই, প্রান্তিক পর্যায়ের বা ঢাকা শহরের বাইরের জেলা বা উপজেলা হাসপাতাল গুলোকে আমার এতিম মনে হয়। মানে এই হাসপাতাল গুলোকে কেউ আগলে রাখে না। না আগলে রাখে হাসপাতালে সেবা নিতে আসা মানুষগুলো, না আগলে রাখে স্থানীয় জনপদের মানুষ। হাসপাতালের প্রতি এই ‘অনাপন’ আচরণের কারণ কি আমার জানা নাই।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে অসন্তোষ নতুন কিছু না। দেশীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা রোগী বান্ধব না, সেটা চিকিৎসকেরাও বলেন, স্বীকার করেন, মানেন এবং এটাও সত্য এখানে হাসপাতালের চিকিৎসকদের কোন প্রকার দোষ নাই। কারণ সিস্টেমটা হাসপাতালের চিকিৎসকদের তৈরী করা না, বরং চিকিৎসকরাই এই সিস্টেমের স্বীকার ও আজ্ঞাবহ দাস।

তাহলে অসন্তোষ থেকেই সাধারণ মানুষ হাসপাতালকে আপন ভাবে না? চিকিৎসক হিসেবে কিছু মানুষের হাসপাতালের প্রতি এই বিরূপ আচরণে আমি কষ্ট পাই।

যেমনঃ ধরুন আপনি একটি জেলার সদর হাসপাতালে গেলেন। একটু সময় করে সেই হাসপাতালের সিড়ি, ওয়ার্ডের বারান্দা, কোরিডোর কিংবা হাসপাতাল ওয়ার্ডের কর্ণার গুলোতে চোখ দেবেন। প্রয়োজনে ছবিও তুলতে পারেন। আপনি কি দেখতে পাবেন সেখানে?

আপনি যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি দেখবেন, সেটা হলো এসব জায়গায় নির্বিচারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পানের পিক ফেলা থাকবে। পানের পিক এর লাল খয়েরী রঙে হাসপাতালের ঐ দেয়ালের মূল সাদা রঙ হারিয়ে গেছে বহু আগেই। মাঝে মাঝে মনে হবে সরকার যদি দেওয়াল গুলোর রঙ সাদা না করে গাঢ় কমলা করে দিতো তাহলেই দেখতে ভালো লাগতো।

আচ্ছা, পানের এই পিক ফেলে দেওয়াল রঙ করার মহান কাজটা কে করে ভাবুন তো? হাসপাতালের চিকিৎসক? হাসপাতালের নার্স? হাসপাতালের পরিচালক / তত্ত্বাবধায়ক? হাসপাতালের সিকিউরিটি গার্ড? হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট?

উত্তরঃ না!

এই পানের পিক ফেলে হাসপাতালটাকে নোংরা করেন হাসপাতালে সেবা নিতে আসা মানুষগুলো। তাৎক্ষনিক অকৃতজ্ঞতার এর থেকে বড় উদাহরণ আর কি-ই বা হতে পারে?

প্রশ্ন আসতে পারে, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা তাহলে কি করেন? হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা অবশ্যই হাসপাতাল পরিষ্কারের কাজ করবেন এবং তারা সেটা প্রতিনিয়ত করেনও। একটা জেলা সদর হাসপাতালও দিনে নিয়ম করে ৩ বার পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু রোগীর সাথে হাসপাতালে এসে, হাসপাতালে পান খেয়ে হাসপাতালের দেওয়ালেই পানের পিক ফেলা কোন ধরণের সভ্যতা? কোন ধরণের শিক্ষা? কোন ধরণের মানবিকতা?

হাসপাতালগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষ এমনই এতিমের মতো আচরণ করেন। হাসপাতালগুলোকে এক ফোঁটাও আপন মনে করেন না। অথচ এই হাসপাতাল তার প্রিয়জনকে আরোগ্য দেয়, চিকিৎসা দেয় আর বিপদে পাশে ত্থাকে।

অফিস টাইমে যদি হাসপাতালে আসেন, অকৃতজ্ঞতার আরো একটি নিদর্শন দেখতে পাবেন। দেখবেন হাসপাতাল ক্যাম্পাসের ভিতরে বাইরে এলো মেলো সবাই সবার গাড়ি, মোটরসাইকেল, ইজি বাইক, অটো-রিকসা, রিকসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন। যে যেভাবে পেরেছেন, রেখে দিয়েছেন। রোগী জরুরী বিভাগের গেটে নামানোর পরে অনেকে ভুলেই যান তার রোগী ছাড়াও আরো জরুরী রোগী হাসপাতালে আসতে পারেন।

মোটরসাইকেল আরোহীরা আরেক কাঠি সরেস! তারা প্রায় সময়ই হাসপাতালের ভিতরে মোটর সাইকেল রেখে চলে যান। কে তাদের শিখিয়েছে যে হাসপাতালের কোরিডোরে বা চিকিৎসকদের রুমের পাশে মোটর সাইকেল রাখা যায়, আমার জানা নাই। তবে তাদের রেখে যাওয়া এই দ্বিচক্রযান রোগীদের প্রকান্ড বিরক্তির কারন হয় তা তারা হয়তো কোনদিন জানবেনও না।

হাসপাতাল ক্যাম্পাসের যানজট! হাসপাতাল ক্যাম্পাসের ভিতরে কোন ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম সরকারী ভাবে নাই। এটারই সুযোগ নেন কতিপয় মানুষ।

হাসপাতালে ব্যক্তিগত গাড়ি, অটোরিকসা, ইজি-বাইক, রিকসা, ভাড়া করা গাড়ি এগুলোর যে বিশৃঙ্খলা দেখা যায়, তা আপনি অন্য কোথাও দেখবেন না। হঠাৎ করে কেউ যদি হাসপাতাল ক্যাম্পাসে আসেন, দেখে মনে হবে আপনি রিকসা, ইজি বাইক কেনা বেচা করার কোন মটো-শো’তে চলে এসেছেন।

হাসপাতালে ঢুকেই যে যার মতো করে অটোরিকসা, রিকসা, ইজি-বাইক রেখে চলে যান। একবারো ভাবেন না এই একই পথে অন্য কোন রোগী হাসপাতালে আসবেন। হয়তো কোন মুমূর্ষু রোগীর অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করবে। অথবা মুমূর্ষু না হোক, হাসপাতালের আসা সাধারণ ঠান্ডা-কাশি-জ্বরের রোগীরাও এসব যন্ত্রযানের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পান না।

সদর হাসপাতালের প্রাচীরের ভিতরে বাইরে একই চিত্র বিদ্যমান। এই বিশৃঙ্খল অবস্থার জন্য অনেক ক্রিটিকাল রোগী সঠিক সময়ে চিকিৎসা পান না। ফলে পরিণতি হয় ভয়াবহ। আমার এমন কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এমন অনেক রোগীকে মৃত ঘোষণা করতে হয়েছে যারা হয়তো আর ১০ মিনিট আগে এসে জরুরী বিভাগে অক্সিজেন পেলে পরিণতি এতোটা ভয়াবহ হতো না। বিশেষতঃ পানিতে ডুবে যাওয়া শ্বাস নিতে না পারা শিশু এবং কার্ডিয়াক রোগীদের জন্য ঠিক সময়ে অক্সিজেন দেওয়াটা খুবই জরুরী এবং লাইভ-সেভিং একটি পদক্ষেপ। কিন্তু হাসপাতালে আসা অটোরিকসার মিছিলে আটকে পরে চিকিৎসা, আটকে পরে বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকু।

মানুষের মৃত্যু বা অসুস্থ মানুষের শারীরিক কষ্টের কারন যদি হয় হাসপাতালে যানজট এর থেকে অমানবিক আর কি হতে পারে? যে কোন স্থানে অবৈধ গাড়ি পার্কিং এর জরিমাণা ৫০০০ টাকা, এটা আমরা সবাই জানি। হাসপাতাল এলাকায় এই একই অপরাধের জরিমানা হওয়া উচিৎ ২০,০০০ টাকা কারণ কতিপয় মানুষের এই অপরিণামদর্শী আচরণের কারনে একজন রোগীর শারীরিক ক্ষতি/মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

জরিমানার এই গালগপ্পো আসলেই একটি প্রলাপ। কারণ সত্যি কথা হলো, হাসপাতালের ভিতরে এবং বাইরে ট্রাফিক কন্ট্রোলের জন্য উপযুক্ত জনবল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নাই। নাই এবং সুদূর ভবিষ্যতেও হবে না। এর কারন হলো, হাসপাতালের তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীত সিংহভাগ পদই ফাঁকা। যদি সকল পদে আগামীকালও নিয়োগ হয়, তাও তা অপ্রতুল হবে। কারন এই জনবল কাঠামো অন্তঃত ৩০ বছর পুরোনো। হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর চাপ এবং সেবার পরিধি। কোনভাবেই সকল কর্মচারী নিয়োগ দিয়েও সেবার মান বাড়ানো সম্ভব না।

এমন পরিস্থিতে আপনি আমি যদি হাসপাতালে এসে আমাদের ব্যক্তিগত গাড়ি, অটোরিকসা, ইজি-বাইক, মোটরসাইকেল নিজেদের ইচ্ছা মতো রেখে দেই, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রোগীরাই। ব্যাহত হবে সেবা। ক্রিটিকাল রোগীরা বাঁচার শেষ আশাটুকুও শেষ হবে। এই সমস্যা সমাধান করতে হবে সাধারণ মানুষকেই। তারা যদি সচেতন না হয়, তারা সুশৃঙ্খল না হয়, তারা যদি অন্যের কষ্টটা না বোঝেন, তাহলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব না।

সবশেষ বলতে চাই, আপনার এলাকার সরকারী হাসপাতালটাকে আপন ভাবুন। এই হাসপাতালটার সাথে এতিমের মতো ব্যবহার করবেন না। কারণ ছুটিতে-হরতালে-উৎসবে-মহামারীতে আপনার এলাকার এই হাসপাতালটাই ২৪ ঘন্টা আপনার পাশে ছিলো। অজস্র সীমাবদ্ধতার মাঝেও হাসপাতালটা এক মুহুর্তের জন্যও বন্ধ ছিলো না। কখনো বন্ধ থাকবেও না। সেবা নিতে হাসপাতালে আসুন, শুধু অনুরোধঃ সেবা নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে হাসপাতালে আসুন। আপনার হাসপাতালে পদার্পন যেন অন্য আরেকজন রোগীর কষ্টের কারণ না হয়।

ট্যাগস : Rajbaribd.com

নিউজটি শেয়ার করুন

হাসপাতাল এতো ‘এতীম’ কেন?

আপডেট সময় : ০১:০৫:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

সোজা সাপটা বলে দেই, প্রান্তিক পর্যায়ের বা ঢাকা শহরের বাইরের জেলা বা উপজেলা হাসপাতাল গুলোকে আমার এতিম মনে হয়। মানে এই হাসপাতাল গুলোকে কেউ আগলে রাখে না। না আগলে রাখে হাসপাতালে সেবা নিতে আসা মানুষগুলো, না আগলে রাখে স্থানীয় জনপদের মানুষ। হাসপাতালের প্রতি এই ‘অনাপন’ আচরণের কারণ কি আমার জানা নাই।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে অসন্তোষ নতুন কিছু না। দেশীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা রোগী বান্ধব না, সেটা চিকিৎসকেরাও বলেন, স্বীকার করেন, মানেন এবং এটাও সত্য এখানে হাসপাতালের চিকিৎসকদের কোন প্রকার দোষ নাই। কারণ সিস্টেমটা হাসপাতালের চিকিৎসকদের তৈরী করা না, বরং চিকিৎসকরাই এই সিস্টেমের স্বীকার ও আজ্ঞাবহ দাস।

তাহলে অসন্তোষ থেকেই সাধারণ মানুষ হাসপাতালকে আপন ভাবে না? চিকিৎসক হিসেবে কিছু মানুষের হাসপাতালের প্রতি এই বিরূপ আচরণে আমি কষ্ট পাই।

যেমনঃ ধরুন আপনি একটি জেলার সদর হাসপাতালে গেলেন। একটু সময় করে সেই হাসপাতালের সিড়ি, ওয়ার্ডের বারান্দা, কোরিডোর কিংবা হাসপাতাল ওয়ার্ডের কর্ণার গুলোতে চোখ দেবেন। প্রয়োজনে ছবিও তুলতে পারেন। আপনি কি দেখতে পাবেন সেখানে?

আপনি যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি দেখবেন, সেটা হলো এসব জায়গায় নির্বিচারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পানের পিক ফেলা থাকবে। পানের পিক এর লাল খয়েরী রঙে হাসপাতালের ঐ দেয়ালের মূল সাদা রঙ হারিয়ে গেছে বহু আগেই। মাঝে মাঝে মনে হবে সরকার যদি দেওয়াল গুলোর রঙ সাদা না করে গাঢ় কমলা করে দিতো তাহলেই দেখতে ভালো লাগতো।

আচ্ছা, পানের এই পিক ফেলে দেওয়াল রঙ করার মহান কাজটা কে করে ভাবুন তো? হাসপাতালের চিকিৎসক? হাসপাতালের নার্স? হাসপাতালের পরিচালক / তত্ত্বাবধায়ক? হাসপাতালের সিকিউরিটি গার্ড? হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট?

উত্তরঃ না!

এই পানের পিক ফেলে হাসপাতালটাকে নোংরা করেন হাসপাতালে সেবা নিতে আসা মানুষগুলো। তাৎক্ষনিক অকৃতজ্ঞতার এর থেকে বড় উদাহরণ আর কি-ই বা হতে পারে?

প্রশ্ন আসতে পারে, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা তাহলে কি করেন? হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা অবশ্যই হাসপাতাল পরিষ্কারের কাজ করবেন এবং তারা সেটা প্রতিনিয়ত করেনও। একটা জেলা সদর হাসপাতালও দিনে নিয়ম করে ৩ বার পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু রোগীর সাথে হাসপাতালে এসে, হাসপাতালে পান খেয়ে হাসপাতালের দেওয়ালেই পানের পিক ফেলা কোন ধরণের সভ্যতা? কোন ধরণের শিক্ষা? কোন ধরণের মানবিকতা?

হাসপাতালগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষ এমনই এতিমের মতো আচরণ করেন। হাসপাতালগুলোকে এক ফোঁটাও আপন মনে করেন না। অথচ এই হাসপাতাল তার প্রিয়জনকে আরোগ্য দেয়, চিকিৎসা দেয় আর বিপদে পাশে ত্থাকে।

অফিস টাইমে যদি হাসপাতালে আসেন, অকৃতজ্ঞতার আরো একটি নিদর্শন দেখতে পাবেন। দেখবেন হাসপাতাল ক্যাম্পাসের ভিতরে বাইরে এলো মেলো সবাই সবার গাড়ি, মোটরসাইকেল, ইজি বাইক, অটো-রিকসা, রিকসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন। যে যেভাবে পেরেছেন, রেখে দিয়েছেন। রোগী জরুরী বিভাগের গেটে নামানোর পরে অনেকে ভুলেই যান তার রোগী ছাড়াও আরো জরুরী রোগী হাসপাতালে আসতে পারেন।

মোটরসাইকেল আরোহীরা আরেক কাঠি সরেস! তারা প্রায় সময়ই হাসপাতালের ভিতরে মোটর সাইকেল রেখে চলে যান। কে তাদের শিখিয়েছে যে হাসপাতালের কোরিডোরে বা চিকিৎসকদের রুমের পাশে মোটর সাইকেল রাখা যায়, আমার জানা নাই। তবে তাদের রেখে যাওয়া এই দ্বিচক্রযান রোগীদের প্রকান্ড বিরক্তির কারন হয় তা তারা হয়তো কোনদিন জানবেনও না।

হাসপাতাল ক্যাম্পাসের যানজট! হাসপাতাল ক্যাম্পাসের ভিতরে কোন ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম সরকারী ভাবে নাই। এটারই সুযোগ নেন কতিপয় মানুষ।

হাসপাতালে ব্যক্তিগত গাড়ি, অটোরিকসা, ইজি-বাইক, রিকসা, ভাড়া করা গাড়ি এগুলোর যে বিশৃঙ্খলা দেখা যায়, তা আপনি অন্য কোথাও দেখবেন না। হঠাৎ করে কেউ যদি হাসপাতাল ক্যাম্পাসে আসেন, দেখে মনে হবে আপনি রিকসা, ইজি বাইক কেনা বেচা করার কোন মটো-শো’তে চলে এসেছেন।

হাসপাতালে ঢুকেই যে যার মতো করে অটোরিকসা, রিকসা, ইজি-বাইক রেখে চলে যান। একবারো ভাবেন না এই একই পথে অন্য কোন রোগী হাসপাতালে আসবেন। হয়তো কোন মুমূর্ষু রোগীর অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করবে। অথবা মুমূর্ষু না হোক, হাসপাতালের আসা সাধারণ ঠান্ডা-কাশি-জ্বরের রোগীরাও এসব যন্ত্রযানের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পান না।

সদর হাসপাতালের প্রাচীরের ভিতরে বাইরে একই চিত্র বিদ্যমান। এই বিশৃঙ্খল অবস্থার জন্য অনেক ক্রিটিকাল রোগী সঠিক সময়ে চিকিৎসা পান না। ফলে পরিণতি হয় ভয়াবহ। আমার এমন কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এমন অনেক রোগীকে মৃত ঘোষণা করতে হয়েছে যারা হয়তো আর ১০ মিনিট আগে এসে জরুরী বিভাগে অক্সিজেন পেলে পরিণতি এতোটা ভয়াবহ হতো না। বিশেষতঃ পানিতে ডুবে যাওয়া শ্বাস নিতে না পারা শিশু এবং কার্ডিয়াক রোগীদের জন্য ঠিক সময়ে অক্সিজেন দেওয়াটা খুবই জরুরী এবং লাইভ-সেভিং একটি পদক্ষেপ। কিন্তু হাসপাতালে আসা অটোরিকসার মিছিলে আটকে পরে চিকিৎসা, আটকে পরে বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকু।

মানুষের মৃত্যু বা অসুস্থ মানুষের শারীরিক কষ্টের কারন যদি হয় হাসপাতালে যানজট এর থেকে অমানবিক আর কি হতে পারে? যে কোন স্থানে অবৈধ গাড়ি পার্কিং এর জরিমাণা ৫০০০ টাকা, এটা আমরা সবাই জানি। হাসপাতাল এলাকায় এই একই অপরাধের জরিমানা হওয়া উচিৎ ২০,০০০ টাকা কারণ কতিপয় মানুষের এই অপরিণামদর্শী আচরণের কারনে একজন রোগীর শারীরিক ক্ষতি/মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

জরিমানার এই গালগপ্পো আসলেই একটি প্রলাপ। কারণ সত্যি কথা হলো, হাসপাতালের ভিতরে এবং বাইরে ট্রাফিক কন্ট্রোলের জন্য উপযুক্ত জনবল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নাই। নাই এবং সুদূর ভবিষ্যতেও হবে না। এর কারন হলো, হাসপাতালের তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীত সিংহভাগ পদই ফাঁকা। যদি সকল পদে আগামীকালও নিয়োগ হয়, তাও তা অপ্রতুল হবে। কারন এই জনবল কাঠামো অন্তঃত ৩০ বছর পুরোনো। হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর চাপ এবং সেবার পরিধি। কোনভাবেই সকল কর্মচারী নিয়োগ দিয়েও সেবার মান বাড়ানো সম্ভব না।

এমন পরিস্থিতে আপনি আমি যদি হাসপাতালে এসে আমাদের ব্যক্তিগত গাড়ি, অটোরিকসা, ইজি-বাইক, মোটরসাইকেল নিজেদের ইচ্ছা মতো রেখে দেই, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রোগীরাই। ব্যাহত হবে সেবা। ক্রিটিকাল রোগীরা বাঁচার শেষ আশাটুকুও শেষ হবে। এই সমস্যা সমাধান করতে হবে সাধারণ মানুষকেই। তারা যদি সচেতন না হয়, তারা সুশৃঙ্খল না হয়, তারা যদি অন্যের কষ্টটা না বোঝেন, তাহলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব না।

সবশেষ বলতে চাই, আপনার এলাকার সরকারী হাসপাতালটাকে আপন ভাবুন। এই হাসপাতালটার সাথে এতিমের মতো ব্যবহার করবেন না। কারণ ছুটিতে-হরতালে-উৎসবে-মহামারীতে আপনার এলাকার এই হাসপাতালটাই ২৪ ঘন্টা আপনার পাশে ছিলো। অজস্র সীমাবদ্ধতার মাঝেও হাসপাতালটা এক মুহুর্তের জন্যও বন্ধ ছিলো না। কখনো বন্ধ থাকবেও না। সেবা নিতে হাসপাতালে আসুন, শুধু অনুরোধঃ সেবা নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে হাসপাতালে আসুন। আপনার হাসপাতালে পদার্পন যেন অন্য আরেকজন রোগীর কষ্টের কারণ না হয়।