ঢাকা ০২:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজবাড়ীতে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ

সুমন বিশ্বাস ॥
  • আপডেট সময় : ০৬:৪৭:৪৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৪
  • / ৯১ বার পড়া হয়েছে

রাজবাড়ীতে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার প্রকল্পে কাজ না করেই টাকা উত্তোলণ করা হয়েছে। আবার ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও দেয়া হয়েছে বরাদ্দ। কোথায়ও আবার প্রকল্পের বিষয়টি জানেই না প্রতিষ্ঠানের প্রধান। খবরের কাগজের অনুসন্ধানে রাজবাড়ী জেলার পাংশা ও কালুখালি উপজেলাতে এমন ১৫টি প্রকল্পের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। জেলা প্রশাসক জানালেন তদন্ত করে জরিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসুচির আওতায় জেলায় টিআর, কাবিটা ও কাবিখা প্রকল্পের  পাংশা উপজেলার যশাই ও কালুখালি উপজেলার মাঝবাড়ী ইউনিয়নে অনুসন্ধান করা হয়।
গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ‘কাবিটা’ (কাজের বিনিময়ে টাকা) প্রকল্পের আওতায় পাংশা উপজেলা পরিষদের অনুকুলে নগদ অর্থের দ্বারা যশাই ইউনিয়নের ‘লক্ষীপুর প্রাইমারী স্কুলের মাঠ ভরাট’ এর জন্য তিন লক্ষ পচিশ হাজার টাকা (৩,২৫,০০০) বরাদ্দ দেয়া হয়। তৎকালিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ জাফর সাদিক চৌধুরী ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রকল্পটির অনুমোদন করেন আর জেলা প্রশাসক অনুমোদন করেন ১৭ সেপ্টেম্বর। খবরের কাগজের এই প্রতিনিধি যশাই ইউনিয়নে লক্ষীপুর প্রাইমারী স্কুল খুজে বের করার চেষ্টা করে। তবে যশাই ইউনিয়নে ‘ লক্ষীপুর প্রাইমারী স্কুল নামে কোন বিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটি বিদ্যালয় পাওয়া যায় সেটির নাম ৫৭ নং চরলক্ষীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।’ বিদ্যালয়টিতে গিয়ে জানা যায়, এমন কোন বরাদ্দ গত অর্থ বছরে এই বিদ্যালয়ে আসেনি। বিদ্যালয়ের সামনে একটি গর্ত রয়েছে সেটি ভরাটের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসে আবেদন করে রেখেছে বিদ্যালয়টির  প্রধান শিক্ষক।
৫৭ নং চরলক্ষীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ মাহফুজুর রহমান বলেন, আমি এই বিদ্যালয়ে ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রয়ারী যোগদান করি। তারপর থেকে এই বিদ্যালয়ে মাঠ ভরাটের জন্য কোন টাকা আসেনি। আপনি বিশ্বাস না করলে শিক্ষা অফিসে খবর নিতে পারেন। আর আমরা মাঠ ভরাটের জন্য উপজেলাতে টাকা চেয়ে কোন আবেদনও করিনি। আপনি যে বিদ্যালয়ের নাম বলছেন ‘লক্ষীপুর প্রাইমারী স্কুল’ এই নামে যশাই ইউনিয়নে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। কিভাবে কারা এই বরাদ্দ দিলো আমি কিছুই জানি না।
যশাই ইউনিয়নে  কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) প্রকল্পের আওতায় ‘কাঞ্চনপুর মসজিদের পাশে মাটি ভরাট’ এর জন্য দেয়া হয় দুই লক্ষ্য টাকা বরাদ্দ। কাঞ্চনপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় গ্রামটিতে দুটি মসজিদ রয়েছে। একটির নাম পূর্ব কাঞ্চনপুর জামে মসজিদ। আরেকটির নাম পশ্চিম কাঞ্চনপুর জামে মসজিদ। দুটি মসজিদের একটিতেও কোন বরাদ্দ আসেনি।
পূর্ব কাঞ্চনপুর জামে মসজিদের ইমাম খবির উদ্দিন প্রামানিক বলেন, আমাদের মসজিদের পাশে একটু নিচু জায়গা ছিল। সেটি আমরা এক ট্রাক বালু এনে নিজেরাই ফেলেছি। কোন টাকা পয়সা আসেনি আমাদের মসজিদে। আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনছি। পশ্চিম কাঞ্চনপুর জামে মসজিদেও কোন বরাদ্দ আসেনি বলে জানান স্থানীয়রা। মসজিদের পাশের বাড়ীর জালাল মোল্লা বলেন, দুইতিন বছর আগে জেলা পরিষদ থেকে আমাদের মসজিদে ওযুখানা তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে দেখেন জেলা পরিষদের নেমপ্লেট লাগানো আছে। আর আমাদের মসজিদে কোন নিচু জায়গা নেই। সেটি ভরাটও হয়নি। একই কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা)  প্রকল্পের আওতায় যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়  চার লক্ষ ১৮ হাজার টাকা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এই প্রকল্পটিরও অনুমোদন দেয় আর জেলা প্রশাসক অনুমোদন করে ১৭ সেপ্টেম্বর। একই বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মাটি ভরাটের জন্য কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য)  প্রকল্পের আওতায় দুই টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়। যশাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে মাটি ভরাটের জন্য দেয়া হয় ৪ টন গম। যশাই বাজারের সামনে গর্ত ভরাটের জন্য দেয়া হয় দুই টন গম। যশাই ইউনিয়ন পরিষদের সামনে গর্ত ভরাটের জন্য দেয়া হয় দুই টন গম। সরেজমিনে দেখা যায়, যশাই বাজারের উত্তরে যশাই উচ্চ বিদ্যালয় ও যশাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর যশাই বাজারের পশ্চিমে যশাই ইউনিয়ন পরিষদ। যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, যশাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও যশাই বাজারের সভাপতি একই ব্যক্তি। যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের দুটি ভবন। একটি চারতলা নতুন ভবন অপরটি দোতলা ভবন। চারতলা ভবনটি উত্তরে আর দোতলা ভবনটি পশ্চিমে অবস্থিত। পূর্ব দিকে যশাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবন আর দক্ষিনে যশাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিনের ঘর অবস্থিত। চারটি ভবনের মাঝখানে ছোট মাঠ। যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের মুল খেলার মাঠ পূর্ব দিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে। দুটি বিদ্যালয়ের ভবন চারদিকে থাকার কারনে সীমানা প্রাচীর প্রয়োজন নেই।
যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক হযরত আলী বলেন, আপনি যে দুটি বরাদ্দের কথা বলছেন এ সম্পর্কে আমাদের বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক কর্মচারী কেউ কিছু জানে না। আপনার কাছ থেকে এই প্রথম শুনলাম। কারণ প্রধান শিক্ষক এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। আবার ৫ আগস্টের আগে তার মামা ছিল এই বিদ্যালয়ের সভপতি। সব কিছু তারাই করতো। আমাদের কোন কিছু জানায় না। গত বছর পশ্চিম দিকে দুই ভবনের মাঝে বিদ্যালয়ের পুরাতন ইট দিয়ে একটু সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছিল। আর আমাদের খেলার মাঠের পাশে কিছু গাছ ছিল সেই গাছ প্রধান শিক্ষক ৪৯ হাজার টাকা বিক্রি করে। সেই টাকা দিয়ে বেকু এনে মাঠ সমান করে। বরাদ্দের টাকা কি করছে আমরা জানি না। আমাদের কখনো জানতে দেয় না।
বিদ্যালয়টির সিনিয়র সহকারি শিক্ষক মোঃ সাজাহান সিরাজ বলেন, আপনি প্রকল্পের টাকা দেখছেন। ২০১৫ সাল থেকে এই প্রধান শিক্ষক আমাদের শিক্ষকদের প্রতি বছরের সেশন ফির টাকা দেয় না। আমাদের পাওনা ১৬ লক্ষ ৭৪ হাজার টাকা সে তুলে খেয়ে ফেলেছে। সে নিজের খেয়াল খুশিমত সব কাজ করে। যশাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানতে চাওয়া হয় কাবিখার (কাজের বিনিময়ে খাদ্য)  বরাদ্দ ৪ টন গম দিয়ে কী কাজ করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক শুক্লা দত্ত বলেন, আমরা কোন বরাদ্দ পায়নি। আমাদের বিদ্যালয়ের মূলত মাঠই নেই। আমাদের শিক্ষার্থীরা হাই স্কুলের মাঠে খেলাধুলা করে। আমরা কিছুই জানি না এই বরাদ্দের বিষয়ে। আপনার কাছ থেকেই জানতে পারলাম। কে বরাদ্দ দিলো কেনই বা দিলো, সেটি কারা তুললো আমরা কেউ কিছুই জানি না। যশাই বাজারে ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাওয়া হয় বাজারে কোথায় গর্ত ভরাট হয়েছে। বাজারের কেউই বিষয়টি জানে না বলে উত্তর দেন। হাসান শেখ নামে একজন বলেন, বাজারের সাথেই আমার বাড়ী। গত ৫ বছরের মধ্যে বাজারের কোথাও মাটি ফেলা দেখিনি। কোথায় গর্ত ভরাট করেছে চেয়ারম্যান জানে বিষয়টি। তিনিই বাজারের সভাপতি।
যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও যশাই ইউনিয়ন পরিষদের সভাপতি মোঃ আবু হোসেন খানের কাছে সকল প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, সমস্ত কাজই সঠিক ভাবে হয়েছে। কাজ সঠিক হয়েছে সেটি দেখেই উপজেলা থেকে কাজের বিল দিয়েছে। সঠিক ভাবে কাজ না হলে উপজেলা থেকে বিল দিত না। আর কাজ হবার পর কেউ অস্বীকার করলে আমার কিছু করার নেই। তিনি আরো বলেন, শুধু আমার বিদ্যালয় না ইউনিয়নের সকল কাজই সঠিক ভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
পাংশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম আবু দারদা বলেন, আমি এই উপজেলায় যোগদান করেছি ১৫ দিন হলো। এখন গত অর্থ বছরের প্রকল্পে কি হয়েছে আমি বলতে পারবো না। কেউ যদি লিখিত অভিযোগ দেয় তখন তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই অবস্থা কালুখালি উপজেলাতে। টিআর প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাজবাড়ী ইউনিয়নের মোহনপুর কেবি একাডেমীর মাঠ ভরাটের জন্য দুই লক্ষ্য টাকার অনুমোদন দেয়। একই দিনে জেলা প্রশাসকও এই টাকার অনুমোদন দেয়। তবে প্রতিষ্ঠানের দেখা যায় এরকম কোন বরাদ্দ এই প্রতিষ্ঠানে আসেনি।
মোহনপুর কেবি একাডেমীর প্রধান শিক্ষক নাসিমা খাতুন বলেন, আমাদের বিদ্যালয়টি এখনো এমপিও ভুক্তি হয়নি।  আমরা শিক্ষকরা বিনা বেতনে এখানে শিক্ষকতা করি। কিন্তু এমন একটি প্রতিষ্ঠানের নামে দুই লক্ষ টাকা কারা তুলে নিলো আমি এর বিচার চাই। আমাদের বিদ্যালয়ে কত সমস্যা । দুই লক্ষ্য টাকা পেলে অনেক উপকার হত। আপনি না এলে এই ঘটনা জানতেও পারতাম না। একই ইউনিয়নে ৬৮ নং দয়রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মাটি ভরাটের জন্য দেয়া বরাদ্দ হয় এক লক্ষ টাকা। বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায় এই টাকার কোন কাজ হয়নি। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক তাপস কুমার প্রামানিক বলেন, এমন কোন টাকা চেয়ে আমি কোথাও আবেদন করি। টাকাও পায়নি। আমি কোথাও কোন স্বাক্ষর করিনি। আপনি না এলে এমন ঘটনা জানতেও পারতাম না এমন ঘটনা।  একই ইউনিয়নের মাঝবাড়ী কাজীপাড়া ঈদগাহ বাউন্ডারী, উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) প্রকল্পের আওতায় ১০ টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়। সংরক্ষিত নারী আসন ৩৭ এর সংসদ সদস্য নাজমা আকতারের অনুকুলে থাকা বরাদ্দ থেকে ২০২৪ সালের ৮ এপ্রিল এই বরাদ্দ দেয়া হয়। মাঝবাড়ী কাজী পাড়া ইদগাহ কমিটির সভাপতি  শফিকুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১০ টন গম এসেছিল ইদগাহ এর নামে। সেই টাকা তুলে আনে সাধারণ সম্পাদক গুলজার।  ঈদগাহতে শুধু একটু দেয়াল রং করেছে। আর বাকি টাকা কি করছে কোন হিসাব দেয় না। আমি বলেছিলাম টাকার হিসাব আমাদের মসজিদে টানিয়ে দাও সেটি দেয় না। এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে পারবো না। সাধারণ সম্পাদক গুলজার হোসেন বলেন, টাকা সবই খরচ হয়েছে। হিসাবও আছে। আর সভাপতি এমন কথা বললে তার সাথে আমি বুঝে নিবে। আপনি যান।
মাঝবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী শরিফুল ইসলাম বলেন, আমি আওয়ামী লীগের দলিয় চেয়ারম্যান না। এজন্য এসব বিশেষ বরাদ্দের কাজ সম্পর্কে কিছুই জানি না। উপজেলা প্রশাসন কাদের মাধ্যমে এসব কাজ করিয়েছে আমি বলতে পারি না। তারাই বলতে পারবে।
কালুখালি উপজেলা নির্বাহ অফিসার মহুয়া আফরোজ বলেন, যে কাজ আমি আসার আগে শেষ হয়েছে। সেই কাজের বিষয়ে আমার কিছু জানার কথা না। তারপরও কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, আপনার কাছ থেকে বিষয়গুলো জানলাম। আমি সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সাথে কথা বলে তদন্ত করে অনিয়ম হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ট্যাগস : Rajbaribd.com

নিউজটি শেয়ার করুন

রাজবাড়ীতে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ

আপডেট সময় : ০৬:৪৭:৪৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৪

রাজবাড়ীতে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার প্রকল্পে কাজ না করেই টাকা উত্তোলণ করা হয়েছে। আবার ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও দেয়া হয়েছে বরাদ্দ। কোথায়ও আবার প্রকল্পের বিষয়টি জানেই না প্রতিষ্ঠানের প্রধান। খবরের কাগজের অনুসন্ধানে রাজবাড়ী জেলার পাংশা ও কালুখালি উপজেলাতে এমন ১৫টি প্রকল্পের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। জেলা প্রশাসক জানালেন তদন্ত করে জরিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসুচির আওতায় জেলায় টিআর, কাবিটা ও কাবিখা প্রকল্পের  পাংশা উপজেলার যশাই ও কালুখালি উপজেলার মাঝবাড়ী ইউনিয়নে অনুসন্ধান করা হয়।
গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ‘কাবিটা’ (কাজের বিনিময়ে টাকা) প্রকল্পের আওতায় পাংশা উপজেলা পরিষদের অনুকুলে নগদ অর্থের দ্বারা যশাই ইউনিয়নের ‘লক্ষীপুর প্রাইমারী স্কুলের মাঠ ভরাট’ এর জন্য তিন লক্ষ পচিশ হাজার টাকা (৩,২৫,০০০) বরাদ্দ দেয়া হয়। তৎকালিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ জাফর সাদিক চৌধুরী ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রকল্পটির অনুমোদন করেন আর জেলা প্রশাসক অনুমোদন করেন ১৭ সেপ্টেম্বর। খবরের কাগজের এই প্রতিনিধি যশাই ইউনিয়নে লক্ষীপুর প্রাইমারী স্কুল খুজে বের করার চেষ্টা করে। তবে যশাই ইউনিয়নে ‘ লক্ষীপুর প্রাইমারী স্কুল নামে কোন বিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটি বিদ্যালয় পাওয়া যায় সেটির নাম ৫৭ নং চরলক্ষীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।’ বিদ্যালয়টিতে গিয়ে জানা যায়, এমন কোন বরাদ্দ গত অর্থ বছরে এই বিদ্যালয়ে আসেনি। বিদ্যালয়ের সামনে একটি গর্ত রয়েছে সেটি ভরাটের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসে আবেদন করে রেখেছে বিদ্যালয়টির  প্রধান শিক্ষক।
৫৭ নং চরলক্ষীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ মাহফুজুর রহমান বলেন, আমি এই বিদ্যালয়ে ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রয়ারী যোগদান করি। তারপর থেকে এই বিদ্যালয়ে মাঠ ভরাটের জন্য কোন টাকা আসেনি। আপনি বিশ্বাস না করলে শিক্ষা অফিসে খবর নিতে পারেন। আর আমরা মাঠ ভরাটের জন্য উপজেলাতে টাকা চেয়ে কোন আবেদনও করিনি। আপনি যে বিদ্যালয়ের নাম বলছেন ‘লক্ষীপুর প্রাইমারী স্কুল’ এই নামে যশাই ইউনিয়নে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। কিভাবে কারা এই বরাদ্দ দিলো আমি কিছুই জানি না।
যশাই ইউনিয়নে  কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) প্রকল্পের আওতায় ‘কাঞ্চনপুর মসজিদের পাশে মাটি ভরাট’ এর জন্য দেয়া হয় দুই লক্ষ্য টাকা বরাদ্দ। কাঞ্চনপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় গ্রামটিতে দুটি মসজিদ রয়েছে। একটির নাম পূর্ব কাঞ্চনপুর জামে মসজিদ। আরেকটির নাম পশ্চিম কাঞ্চনপুর জামে মসজিদ। দুটি মসজিদের একটিতেও কোন বরাদ্দ আসেনি।
পূর্ব কাঞ্চনপুর জামে মসজিদের ইমাম খবির উদ্দিন প্রামানিক বলেন, আমাদের মসজিদের পাশে একটু নিচু জায়গা ছিল। সেটি আমরা এক ট্রাক বালু এনে নিজেরাই ফেলেছি। কোন টাকা পয়সা আসেনি আমাদের মসজিদে। আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনছি। পশ্চিম কাঞ্চনপুর জামে মসজিদেও কোন বরাদ্দ আসেনি বলে জানান স্থানীয়রা। মসজিদের পাশের বাড়ীর জালাল মোল্লা বলেন, দুইতিন বছর আগে জেলা পরিষদ থেকে আমাদের মসজিদে ওযুখানা তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে দেখেন জেলা পরিষদের নেমপ্লেট লাগানো আছে। আর আমাদের মসজিদে কোন নিচু জায়গা নেই। সেটি ভরাটও হয়নি। একই কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা)  প্রকল্পের আওতায় যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়  চার লক্ষ ১৮ হাজার টাকা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এই প্রকল্পটিরও অনুমোদন দেয় আর জেলা প্রশাসক অনুমোদন করে ১৭ সেপ্টেম্বর। একই বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মাটি ভরাটের জন্য কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য)  প্রকল্পের আওতায় দুই টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়। যশাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে মাটি ভরাটের জন্য দেয়া হয় ৪ টন গম। যশাই বাজারের সামনে গর্ত ভরাটের জন্য দেয়া হয় দুই টন গম। যশাই ইউনিয়ন পরিষদের সামনে গর্ত ভরাটের জন্য দেয়া হয় দুই টন গম। সরেজমিনে দেখা যায়, যশাই বাজারের উত্তরে যশাই উচ্চ বিদ্যালয় ও যশাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর যশাই বাজারের পশ্চিমে যশাই ইউনিয়ন পরিষদ। যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, যশাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও যশাই বাজারের সভাপতি একই ব্যক্তি। যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের দুটি ভবন। একটি চারতলা নতুন ভবন অপরটি দোতলা ভবন। চারতলা ভবনটি উত্তরে আর দোতলা ভবনটি পশ্চিমে অবস্থিত। পূর্ব দিকে যশাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবন আর দক্ষিনে যশাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিনের ঘর অবস্থিত। চারটি ভবনের মাঝখানে ছোট মাঠ। যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের মুল খেলার মাঠ পূর্ব দিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে। দুটি বিদ্যালয়ের ভবন চারদিকে থাকার কারনে সীমানা প্রাচীর প্রয়োজন নেই।
যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক হযরত আলী বলেন, আপনি যে দুটি বরাদ্দের কথা বলছেন এ সম্পর্কে আমাদের বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক কর্মচারী কেউ কিছু জানে না। আপনার কাছ থেকে এই প্রথম শুনলাম। কারণ প্রধান শিক্ষক এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। আবার ৫ আগস্টের আগে তার মামা ছিল এই বিদ্যালয়ের সভপতি। সব কিছু তারাই করতো। আমাদের কোন কিছু জানায় না। গত বছর পশ্চিম দিকে দুই ভবনের মাঝে বিদ্যালয়ের পুরাতন ইট দিয়ে একটু সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছিল। আর আমাদের খেলার মাঠের পাশে কিছু গাছ ছিল সেই গাছ প্রধান শিক্ষক ৪৯ হাজার টাকা বিক্রি করে। সেই টাকা দিয়ে বেকু এনে মাঠ সমান করে। বরাদ্দের টাকা কি করছে আমরা জানি না। আমাদের কখনো জানতে দেয় না।
বিদ্যালয়টির সিনিয়র সহকারি শিক্ষক মোঃ সাজাহান সিরাজ বলেন, আপনি প্রকল্পের টাকা দেখছেন। ২০১৫ সাল থেকে এই প্রধান শিক্ষক আমাদের শিক্ষকদের প্রতি বছরের সেশন ফির টাকা দেয় না। আমাদের পাওনা ১৬ লক্ষ ৭৪ হাজার টাকা সে তুলে খেয়ে ফেলেছে। সে নিজের খেয়াল খুশিমত সব কাজ করে। যশাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানতে চাওয়া হয় কাবিখার (কাজের বিনিময়ে খাদ্য)  বরাদ্দ ৪ টন গম দিয়ে কী কাজ করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক শুক্লা দত্ত বলেন, আমরা কোন বরাদ্দ পায়নি। আমাদের বিদ্যালয়ের মূলত মাঠই নেই। আমাদের শিক্ষার্থীরা হাই স্কুলের মাঠে খেলাধুলা করে। আমরা কিছুই জানি না এই বরাদ্দের বিষয়ে। আপনার কাছ থেকেই জানতে পারলাম। কে বরাদ্দ দিলো কেনই বা দিলো, সেটি কারা তুললো আমরা কেউ কিছুই জানি না। যশাই বাজারে ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাওয়া হয় বাজারে কোথায় গর্ত ভরাট হয়েছে। বাজারের কেউই বিষয়টি জানে না বলে উত্তর দেন। হাসান শেখ নামে একজন বলেন, বাজারের সাথেই আমার বাড়ী। গত ৫ বছরের মধ্যে বাজারের কোথাও মাটি ফেলা দেখিনি। কোথায় গর্ত ভরাট করেছে চেয়ারম্যান জানে বিষয়টি। তিনিই বাজারের সভাপতি।
যশাই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও যশাই ইউনিয়ন পরিষদের সভাপতি মোঃ আবু হোসেন খানের কাছে সকল প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, সমস্ত কাজই সঠিক ভাবে হয়েছে। কাজ সঠিক হয়েছে সেটি দেখেই উপজেলা থেকে কাজের বিল দিয়েছে। সঠিক ভাবে কাজ না হলে উপজেলা থেকে বিল দিত না। আর কাজ হবার পর কেউ অস্বীকার করলে আমার কিছু করার নেই। তিনি আরো বলেন, শুধু আমার বিদ্যালয় না ইউনিয়নের সকল কাজই সঠিক ভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
পাংশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম আবু দারদা বলেন, আমি এই উপজেলায় যোগদান করেছি ১৫ দিন হলো। এখন গত অর্থ বছরের প্রকল্পে কি হয়েছে আমি বলতে পারবো না। কেউ যদি লিখিত অভিযোগ দেয় তখন তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই অবস্থা কালুখালি উপজেলাতে। টিআর প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাজবাড়ী ইউনিয়নের মোহনপুর কেবি একাডেমীর মাঠ ভরাটের জন্য দুই লক্ষ্য টাকার অনুমোদন দেয়। একই দিনে জেলা প্রশাসকও এই টাকার অনুমোদন দেয়। তবে প্রতিষ্ঠানের দেখা যায় এরকম কোন বরাদ্দ এই প্রতিষ্ঠানে আসেনি।
মোহনপুর কেবি একাডেমীর প্রধান শিক্ষক নাসিমা খাতুন বলেন, আমাদের বিদ্যালয়টি এখনো এমপিও ভুক্তি হয়নি।  আমরা শিক্ষকরা বিনা বেতনে এখানে শিক্ষকতা করি। কিন্তু এমন একটি প্রতিষ্ঠানের নামে দুই লক্ষ টাকা কারা তুলে নিলো আমি এর বিচার চাই। আমাদের বিদ্যালয়ে কত সমস্যা । দুই লক্ষ্য টাকা পেলে অনেক উপকার হত। আপনি না এলে এই ঘটনা জানতেও পারতাম না। একই ইউনিয়নে ৬৮ নং দয়রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মাটি ভরাটের জন্য দেয়া বরাদ্দ হয় এক লক্ষ টাকা। বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায় এই টাকার কোন কাজ হয়নি। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক তাপস কুমার প্রামানিক বলেন, এমন কোন টাকা চেয়ে আমি কোথাও আবেদন করি। টাকাও পায়নি। আমি কোথাও কোন স্বাক্ষর করিনি। আপনি না এলে এমন ঘটনা জানতেও পারতাম না এমন ঘটনা।  একই ইউনিয়নের মাঝবাড়ী কাজীপাড়া ঈদগাহ বাউন্ডারী, উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) প্রকল্পের আওতায় ১০ টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়। সংরক্ষিত নারী আসন ৩৭ এর সংসদ সদস্য নাজমা আকতারের অনুকুলে থাকা বরাদ্দ থেকে ২০২৪ সালের ৮ এপ্রিল এই বরাদ্দ দেয়া হয়। মাঝবাড়ী কাজী পাড়া ইদগাহ কমিটির সভাপতি  শফিকুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১০ টন গম এসেছিল ইদগাহ এর নামে। সেই টাকা তুলে আনে সাধারণ সম্পাদক গুলজার।  ঈদগাহতে শুধু একটু দেয়াল রং করেছে। আর বাকি টাকা কি করছে কোন হিসাব দেয় না। আমি বলেছিলাম টাকার হিসাব আমাদের মসজিদে টানিয়ে দাও সেটি দেয় না। এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে পারবো না। সাধারণ সম্পাদক গুলজার হোসেন বলেন, টাকা সবই খরচ হয়েছে। হিসাবও আছে। আর সভাপতি এমন কথা বললে তার সাথে আমি বুঝে নিবে। আপনি যান।
মাঝবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী শরিফুল ইসলাম বলেন, আমি আওয়ামী লীগের দলিয় চেয়ারম্যান না। এজন্য এসব বিশেষ বরাদ্দের কাজ সম্পর্কে কিছুই জানি না। উপজেলা প্রশাসন কাদের মাধ্যমে এসব কাজ করিয়েছে আমি বলতে পারি না। তারাই বলতে পারবে।
কালুখালি উপজেলা নির্বাহ অফিসার মহুয়া আফরোজ বলেন, যে কাজ আমি আসার আগে শেষ হয়েছে। সেই কাজের বিষয়ে আমার কিছু জানার কথা না। তারপরও কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, আপনার কাছ থেকে বিষয়গুলো জানলাম। আমি সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সাথে কথা বলে তদন্ত করে অনিয়ম হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।