ঢাকা ১১:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

প্রতিনিয়ত রোগীদের সাথে ‘প্রতারণা’ করি ?!

ডাঃ রাজীব দে সরকার, সার্জারী বিশেষজ্ঞ, শিশু রোগ চিকিৎসক ও সার্জন এবং কলামিস্ট
  • আপডেট সময় : ১২:৪৪:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫
  • / ৬৮ বার পড়া হয়েছে

খুব গম্ভীর লেখালেখি করে পাঠকদের বিরক্তির কারণ হতে চাই না।

ধরুন, আপনি একটি জেলার সদর হাসপাতালে গেলেন। গেলে কি দেখবেন? দেখবেন ইনডোরে রোগীরা শুয়ে-বসে আছেন। আর আউটডোরে নানা বয়সের নানা পেশার রোগী আর রোগীর স্বজনেরা এসে চিকিৎসকের রুমের সামনে ভিড় করে দাঁঁড়িয়ে আছেন। অনেক হাসপাতালে রোগীদের বসার জন্য উপযুক্ত স্থানটুকু পর্যন্ত থাকে না। ফলে গায়ে ধুম জ্বর নিয়ে, প্রচন্ড কাঁপুনি নিয়ে, শ্বাসকষ্ট নিয়ে, হাঁড়ের ব্যাথা কিংবা মাথা ব্যাথা নিয়ে সকল বয়সের রোগীদেরই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় একদিকে রোগ যেমন তাকে শারীরিক কষ্টে রেখেছে, আউটডোরের পরিবেশ যেন তাকে আরো এক দফা বেশি কষ্ট দিচ্ছে।

সরকারী হাসপাতালের আউটডোর মূলতঃ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ‘সর্ববৃহৎ’ সার্ভিস ফ্রন্টলাইন। অর্থাৎ রোগীদের অনেক বড় একটি বাল্ক এই আউটডোর বা ওপিডির মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করেন।

আমরা অনেকেই ছোটখাটো শারীরিক সমস্যায় নিজেরাই ওষুধ খেয়ে ফেলি। অথবা ফার্মেসীর দোকানদারকে নিজের মূর্খ মনে ডাক্তার হিসেবে মর্যাদা দিয়ে তার কাছেই পরামর্শ চেয়ে ওষুধ খেলে ফেলি। তাতেও যদি না সারে, কয়েক পিস এন্টিবায়োটিক পেটে চালান করে দেই নির্দ্বিধায়। এরপরেও যখন অসুস্থতা কমে না, তখন সরকারী হাসপাতালের আউটডোরে আসি একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে।

কিন্তু কি হয় এই আউটডোরে? ফিরে আসি সদর হাসপাতালের আউটডোরে।

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ সকাল .০০ টা থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকবে। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর ওপিডি টাইম আরও সীমিত। ৯০% রোগী সকাল ৯টা ৩০ মিনিটের পরে আসতে শুরু করেন এবং এদিকে আবার সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী টিকিট বিক্রি বন্ধ হয়ে যায় দুপুর ১.০০ টায়। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১.০০ টা পর্যন্ত এই সময়টাই আসলে একজন চিকিৎসকের সংস্পর্শে আসেন রোগীরা, সরল অংকে যার পরিমাণ মাত্র তিন ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট বা ২১০ মিনিট
এই অল্প সময়ে, একটি জেলা সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগের একটি সিঙ্গেল রুমে একজন চিকিৎসককে একাই ১৫০ থেকে ৩০০ রোগী দেখতে হয়। এই সংখ্যা কখনো কখনো ৩৫০-ও স্পর্শ করে। এর মানে দাঁড়ায়, একজন রোগীর জন্য ডাক্তার গড়ে মাত্র ৪২ থেকে ৮৪ সেকেন্ড সময় পান।

কি কি করতে হয় একজন চিকিৎসককে এই সময়ের মধ্যে?

(১) রোগী শারীরিক সমস্যা শোনা, (২) রোগীকে শারীরিক ভাবে পরীক্ষা করা, (৩) পুরোনো কোন চিকিৎসাপত্র বা রিপোর্ট থাকলে সেগুলো দেখা, (৪) একটি প্রোভিশোনাল বা খসড়া ডায়াগনোসিস এ পৌছানো, (৫) সেই অনুযায়ী ওষুধ লেখা, (৬) লেখা ওষুধের মেডিসিন স্লিপ লিখে দেওয়া, (৭) অনেক সময় পেশেন্ট রেজিস্টারে রোগী তথ্য লেখা (এই কাজটা অবশ্য সব সময় চিকিৎসককে করতে হয় না)

আচ্ছা, আপনি রোগী বা চিকিৎসক না, সাধারণ একজন পাঠক হিসেবে ভাবুন তো, এই ৪২ থেকে ৮৪ সেকেন্ড (বা তর্কের খাতিরে সময়টাকে যদি ২/৩ মিনিটও ধরে নেই) সময়টা কি চিকিৎসার মতো একটি প্রচন্ড সংবেদনশীল কাজ করার জন্য যথেষ্ট? তাহলে এই ২ মিনিটে যে চিকিৎসাসেবা রোগী পাবেন, তা কি রোগীর সাথে এক প্রকার প্রতারণা নয়?

তবে মজা হলো এখানে বিশাল এক “শুভঙ্করের ফাঁকি” আছে। পুরুষ আউটডোরে এবং মহিলা আউটডোরে আগত রোগীদের একটি বড় অংশ আসেন শুধু ফ্রী মেডিসিন নিতে। এদের অনেকেরই এসব মেডিসিনের কোন প্রয়োজন নাই। কেউ কেউ আসেন অন্য কারো জন্য মেডিসিন নিতে। অনেকে এসেই বলেন, “ব্যাথার বড়ি দেন ২ পাতা, জ্বরের বড়ি দেন ২ পাতা, গ্যাসের বড়ি দেন ২ পাতা, আমাশার বড়ি দেন ২ পাতা”

আপনার শুনে মনে হতেই পারে, কেউ যদি এভাবে চেয়ে ওষুধ নিয়ে যায়, তাতে সমস্যা কি? সমস্যা হলো, এসব ওষুধ বিতরণে আর যাই হোক চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় না। কারণ এসব ওষুধ কোন চিকিৎসক প্রেসক্রাইব করেন নি। অর্থাৎ আদৌ এ ওষুধ তার প্রয়োজন কী না সেটা জানা গেলো না। অন্যদিকে অপর একজন রোগী যার হয়তো আসলেই ওষুধ গুলো প্রয়োজন ছিলো তিনি আর ওষুধ গুলো পান না। কারন সরকারী সাপ্লাই তো আর সীমাহীন না।

এই ডেঙ্গু মৌসুমে জ্বরের একজন রোগীকে কোনভাবেই ‘ব্যাথার ওষুধ’ দেওয়া যাবে না। এটা হবে তার জন্য ভয়ংকর একটি বিষয়। জ্বর থাকা কালীন এই ব্যাথার ওষুধ সেবন তার জন্য ভয়ংকর পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

আবার যে মানুষটার ডায়রিয়া বা আমাশয় আছে, তাকে সরকারী হাসপাতালের প্রচলিত পিপিআই (গ্যাসের বড়ি) দেওয়া যাবে না। এতে তার পেটের এই সমস্যা কমবে তো না, বরং তুমুল আকারে বাড়বে। কিন্তু এসব কথা রোগীদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করাই একটি পন্ডশ্রম। যিনি ঠিক করেই এসেছেন, আমি যেভাবেই পারি ৫ টাকার টিকেটের বিনিময়ে অন্তঃত ৩০০/৪০০ টাকার ওষুধ না নিয়ে বাড়ি ফিরবো না, তাকে স্বাস্থ্য পরামর্শ দিতে যাওয়াটা অনেক দুরূহ একটি কাজ। আর এই দুরূহ কাজটির জন্য সময় পাওয়া যায় ৪২ থেকে ৮৪ সেকেন্ডের আশেপাশে।

আউটডোরের নিধিরাম চিকিৎসক পরেন আরেক বিড়ম্বনায়। কারণ রোগীদের এই চাপের কারণে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারেন না। বার বার তাকেই বলতে হয়,”আপনারা দয়া করে সিরিয়াল ধরে আসুন” “আপনারা দয়া করে রুমের ভিতর হৈ চৈ করবেন না“।

সত্যি কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় আউটডোরের সামনে থাকা কর্মচারীকে কোন রকম তোয়াক্কা না করেই ভেতরে ৫/৭ জন চিকিৎসকের কক্ষে রোগী ঢুকে পরেন। ফলে চিকিৎসকের রুমের ভেতর একট শোরগোল পরিবেশ তৈরী হয়। এ সময় অসুস্থ রোগী চিকিৎসককে ভালো মতো তার সমস্যার কথাগুলো পর্যন্ত বলতে পারেন না। আদতে রোগীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। চিকিৎসকের কক্ষকে তখন সেবাকক্ষ মনে হয় না, মনে হয় যেন একটি জনজমাট স্থানীয় বাজার!

আবার চিকিৎসক নিজেও যে উঠে একটু ওয়াশরুমে যাবেন, হালকা কিছু নাস্তা করবেন, সেই অবস্থাও থাকে না। অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীরা এই সুযোগটা পেলেও চিকিৎসক আর চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারে না, কারন তার সামনে একটি অসুস্থ শরীর বসে থাকে। চিকিৎসকরা এর গুরুত্ব বোঝেন।

আউটডোরে রোগীদের এই দুর্ভোগ বা চিকিৎসা-প্রহসন কমাতে হলে বা বন্ধ করতে হলে কি করতে হবে?

এই সংকটের সমাধান ট্রায়াজ সিস্টেম এর কার্যকর প্রয়োগের মধ্যেই নিহিত, যা উন্নত দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে বহির্বিভাগের সেবাটা  অন্যরকম ভাবে পরিচালিত হয়। রোগীরা হাসপাতালে আসার পর একজন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী তাদের শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করেন এবং রোগের বা লক্ষণের তীব্রতা নিরূপন করেন। শুধুমাত্র যারা তাত্ক্ষণিক সেবার প্রয়োজন তাদের দ্রুত ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়, বাকিদের অপেক্ষার জন্য নির্ধারিত সময় দেওয়া হয় বা পরবর্তী তারিখে দেখা করার ব্যবস্থা করা হয়। এই পদ্ধতি নিশ্চিত করে যে একজন ডাক্তার তার প্রতিজন রোগীর জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে পারেন, যা রোগ নির্ণয়ে সাফল্য আনে এবং সঠিক চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে তা হলো বিনামূল্যের ওষুধ হলেও তার যথেচ্ছ বিতরণ বন্ধ করতে হবে। যার প্রয়োজন নেই, তিনি অন্যায়ভাবে ওষুধ দাবী করলে তাকে আইনী প্রক্রিয়ায় জরিমানা করতে হবে। কারন তিনি অন্য একজন রোগীর অধিকার খর্ব করছেন এবং দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষতি করছেন। অন্যদিকে ক্রনিক রোগে আক্রান্ত রোগীরা যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন এর রোগীরা সরাসরি হেলথ কার্ড এর মাধ্যমে ওষুধ গ্রহণ করবেন এবং প্রতি সপ্তাহে কি পরিমাণ ওষুধ পাবেন, তা সুনির্দিষ্ট থাকবে। তারা অযথা হাসপাতালের আউটডোর সেকশনে এসে ভিড় করবেন না।

আমার মনে করি, বর্তমানে আমরা যেভাবে বহিঃবিভাগ সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করি তাতে আমরা রোগীদের আরো বেশি ক্ষতি করি। একই সাথে সরকারি ঔষধের নির্বিচারে অপব্যবহার করি যার এন্টিবায়োটিক রেজিস্টান্স এর মতো মারাত্নক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে ফেলেছে। চিকিৎসক নিজেও তার শ্রম, মেধা আর জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারছেন না। তিনিও শুধু আউটডোরে বসা ‘ওষুধ ডেলিভারি পারসন’ হয়ে যাচ্ছেন। এ ধরনের ওপিডি সিস্টেম স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও অর্থনীতির অন্য হুমকি।

রেলের টিকেট টাও এখন এনআইডি দিয়ে অনলাইনে কাটতে হয়। তাই পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ফার্মসী সার্ভিসও প্রযুক্তিনির্ভর করার কোন বিকল্প নাই। নাহলে রোগীদের সাথে সিস্টেমের এই ‘প্রতারণা’ চলতেই থাকবে।

ট্যাগস : Rajbaribd.com

নিউজটি শেয়ার করুন

প্রতিনিয়ত রোগীদের সাথে ‘প্রতারণা’ করি ?!

আপডেট সময় : ১২:৪৪:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫

খুব গম্ভীর লেখালেখি করে পাঠকদের বিরক্তির কারণ হতে চাই না।

ধরুন, আপনি একটি জেলার সদর হাসপাতালে গেলেন। গেলে কি দেখবেন? দেখবেন ইনডোরে রোগীরা শুয়ে-বসে আছেন। আর আউটডোরে নানা বয়সের নানা পেশার রোগী আর রোগীর স্বজনেরা এসে চিকিৎসকের রুমের সামনে ভিড় করে দাঁঁড়িয়ে আছেন। অনেক হাসপাতালে রোগীদের বসার জন্য উপযুক্ত স্থানটুকু পর্যন্ত থাকে না। ফলে গায়ে ধুম জ্বর নিয়ে, প্রচন্ড কাঁপুনি নিয়ে, শ্বাসকষ্ট নিয়ে, হাঁড়ের ব্যাথা কিংবা মাথা ব্যাথা নিয়ে সকল বয়সের রোগীদেরই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় একদিকে রোগ যেমন তাকে শারীরিক কষ্টে রেখেছে, আউটডোরের পরিবেশ যেন তাকে আরো এক দফা বেশি কষ্ট দিচ্ছে।

সরকারী হাসপাতালের আউটডোর মূলতঃ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ‘সর্ববৃহৎ’ সার্ভিস ফ্রন্টলাইন। অর্থাৎ রোগীদের অনেক বড় একটি বাল্ক এই আউটডোর বা ওপিডির মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করেন।

আমরা অনেকেই ছোটখাটো শারীরিক সমস্যায় নিজেরাই ওষুধ খেয়ে ফেলি। অথবা ফার্মেসীর দোকানদারকে নিজের মূর্খ মনে ডাক্তার হিসেবে মর্যাদা দিয়ে তার কাছেই পরামর্শ চেয়ে ওষুধ খেলে ফেলি। তাতেও যদি না সারে, কয়েক পিস এন্টিবায়োটিক পেটে চালান করে দেই নির্দ্বিধায়। এরপরেও যখন অসুস্থতা কমে না, তখন সরকারী হাসপাতালের আউটডোরে আসি একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে।

কিন্তু কি হয় এই আউটডোরে? ফিরে আসি সদর হাসপাতালের আউটডোরে।

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ সকাল .০০ টা থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকবে। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর ওপিডি টাইম আরও সীমিত। ৯০% রোগী সকাল ৯টা ৩০ মিনিটের পরে আসতে শুরু করেন এবং এদিকে আবার সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী টিকিট বিক্রি বন্ধ হয়ে যায় দুপুর ১.০০ টায়। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১.০০ টা পর্যন্ত এই সময়টাই আসলে একজন চিকিৎসকের সংস্পর্শে আসেন রোগীরা, সরল অংকে যার পরিমাণ মাত্র তিন ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট বা ২১০ মিনিট
এই অল্প সময়ে, একটি জেলা সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগের একটি সিঙ্গেল রুমে একজন চিকিৎসককে একাই ১৫০ থেকে ৩০০ রোগী দেখতে হয়। এই সংখ্যা কখনো কখনো ৩৫০-ও স্পর্শ করে। এর মানে দাঁড়ায়, একজন রোগীর জন্য ডাক্তার গড়ে মাত্র ৪২ থেকে ৮৪ সেকেন্ড সময় পান।

কি কি করতে হয় একজন চিকিৎসককে এই সময়ের মধ্যে?

(১) রোগী শারীরিক সমস্যা শোনা, (২) রোগীকে শারীরিক ভাবে পরীক্ষা করা, (৩) পুরোনো কোন চিকিৎসাপত্র বা রিপোর্ট থাকলে সেগুলো দেখা, (৪) একটি প্রোভিশোনাল বা খসড়া ডায়াগনোসিস এ পৌছানো, (৫) সেই অনুযায়ী ওষুধ লেখা, (৬) লেখা ওষুধের মেডিসিন স্লিপ লিখে দেওয়া, (৭) অনেক সময় পেশেন্ট রেজিস্টারে রোগী তথ্য লেখা (এই কাজটা অবশ্য সব সময় চিকিৎসককে করতে হয় না)

আচ্ছা, আপনি রোগী বা চিকিৎসক না, সাধারণ একজন পাঠক হিসেবে ভাবুন তো, এই ৪২ থেকে ৮৪ সেকেন্ড (বা তর্কের খাতিরে সময়টাকে যদি ২/৩ মিনিটও ধরে নেই) সময়টা কি চিকিৎসার মতো একটি প্রচন্ড সংবেদনশীল কাজ করার জন্য যথেষ্ট? তাহলে এই ২ মিনিটে যে চিকিৎসাসেবা রোগী পাবেন, তা কি রোগীর সাথে এক প্রকার প্রতারণা নয়?

তবে মজা হলো এখানে বিশাল এক “শুভঙ্করের ফাঁকি” আছে। পুরুষ আউটডোরে এবং মহিলা আউটডোরে আগত রোগীদের একটি বড় অংশ আসেন শুধু ফ্রী মেডিসিন নিতে। এদের অনেকেরই এসব মেডিসিনের কোন প্রয়োজন নাই। কেউ কেউ আসেন অন্য কারো জন্য মেডিসিন নিতে। অনেকে এসেই বলেন, “ব্যাথার বড়ি দেন ২ পাতা, জ্বরের বড়ি দেন ২ পাতা, গ্যাসের বড়ি দেন ২ পাতা, আমাশার বড়ি দেন ২ পাতা”

আপনার শুনে মনে হতেই পারে, কেউ যদি এভাবে চেয়ে ওষুধ নিয়ে যায়, তাতে সমস্যা কি? সমস্যা হলো, এসব ওষুধ বিতরণে আর যাই হোক চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় না। কারণ এসব ওষুধ কোন চিকিৎসক প্রেসক্রাইব করেন নি। অর্থাৎ আদৌ এ ওষুধ তার প্রয়োজন কী না সেটা জানা গেলো না। অন্যদিকে অপর একজন রোগী যার হয়তো আসলেই ওষুধ গুলো প্রয়োজন ছিলো তিনি আর ওষুধ গুলো পান না। কারন সরকারী সাপ্লাই তো আর সীমাহীন না।

এই ডেঙ্গু মৌসুমে জ্বরের একজন রোগীকে কোনভাবেই ‘ব্যাথার ওষুধ’ দেওয়া যাবে না। এটা হবে তার জন্য ভয়ংকর একটি বিষয়। জ্বর থাকা কালীন এই ব্যাথার ওষুধ সেবন তার জন্য ভয়ংকর পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

আবার যে মানুষটার ডায়রিয়া বা আমাশয় আছে, তাকে সরকারী হাসপাতালের প্রচলিত পিপিআই (গ্যাসের বড়ি) দেওয়া যাবে না। এতে তার পেটের এই সমস্যা কমবে তো না, বরং তুমুল আকারে বাড়বে। কিন্তু এসব কথা রোগীদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করাই একটি পন্ডশ্রম। যিনি ঠিক করেই এসেছেন, আমি যেভাবেই পারি ৫ টাকার টিকেটের বিনিময়ে অন্তঃত ৩০০/৪০০ টাকার ওষুধ না নিয়ে বাড়ি ফিরবো না, তাকে স্বাস্থ্য পরামর্শ দিতে যাওয়াটা অনেক দুরূহ একটি কাজ। আর এই দুরূহ কাজটির জন্য সময় পাওয়া যায় ৪২ থেকে ৮৪ সেকেন্ডের আশেপাশে।

আউটডোরের নিধিরাম চিকিৎসক পরেন আরেক বিড়ম্বনায়। কারণ রোগীদের এই চাপের কারণে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারেন না। বার বার তাকেই বলতে হয়,”আপনারা দয়া করে সিরিয়াল ধরে আসুন” “আপনারা দয়া করে রুমের ভিতর হৈ চৈ করবেন না“।

সত্যি কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় আউটডোরের সামনে থাকা কর্মচারীকে কোন রকম তোয়াক্কা না করেই ভেতরে ৫/৭ জন চিকিৎসকের কক্ষে রোগী ঢুকে পরেন। ফলে চিকিৎসকের রুমের ভেতর একট শোরগোল পরিবেশ তৈরী হয়। এ সময় অসুস্থ রোগী চিকিৎসককে ভালো মতো তার সমস্যার কথাগুলো পর্যন্ত বলতে পারেন না। আদতে রোগীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। চিকিৎসকের কক্ষকে তখন সেবাকক্ষ মনে হয় না, মনে হয় যেন একটি জনজমাট স্থানীয় বাজার!

আবার চিকিৎসক নিজেও যে উঠে একটু ওয়াশরুমে যাবেন, হালকা কিছু নাস্তা করবেন, সেই অবস্থাও থাকে না। অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীরা এই সুযোগটা পেলেও চিকিৎসক আর চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারে না, কারন তার সামনে একটি অসুস্থ শরীর বসে থাকে। চিকিৎসকরা এর গুরুত্ব বোঝেন।

আউটডোরে রোগীদের এই দুর্ভোগ বা চিকিৎসা-প্রহসন কমাতে হলে বা বন্ধ করতে হলে কি করতে হবে?

এই সংকটের সমাধান ট্রায়াজ সিস্টেম এর কার্যকর প্রয়োগের মধ্যেই নিহিত, যা উন্নত দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে বহির্বিভাগের সেবাটা  অন্যরকম ভাবে পরিচালিত হয়। রোগীরা হাসপাতালে আসার পর একজন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী তাদের শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করেন এবং রোগের বা লক্ষণের তীব্রতা নিরূপন করেন। শুধুমাত্র যারা তাত্ক্ষণিক সেবার প্রয়োজন তাদের দ্রুত ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়, বাকিদের অপেক্ষার জন্য নির্ধারিত সময় দেওয়া হয় বা পরবর্তী তারিখে দেখা করার ব্যবস্থা করা হয়। এই পদ্ধতি নিশ্চিত করে যে একজন ডাক্তার তার প্রতিজন রোগীর জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে পারেন, যা রোগ নির্ণয়ে সাফল্য আনে এবং সঠিক চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে তা হলো বিনামূল্যের ওষুধ হলেও তার যথেচ্ছ বিতরণ বন্ধ করতে হবে। যার প্রয়োজন নেই, তিনি অন্যায়ভাবে ওষুধ দাবী করলে তাকে আইনী প্রক্রিয়ায় জরিমানা করতে হবে। কারন তিনি অন্য একজন রোগীর অধিকার খর্ব করছেন এবং দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষতি করছেন। অন্যদিকে ক্রনিক রোগে আক্রান্ত রোগীরা যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন এর রোগীরা সরাসরি হেলথ কার্ড এর মাধ্যমে ওষুধ গ্রহণ করবেন এবং প্রতি সপ্তাহে কি পরিমাণ ওষুধ পাবেন, তা সুনির্দিষ্ট থাকবে। তারা অযথা হাসপাতালের আউটডোর সেকশনে এসে ভিড় করবেন না।

আমার মনে করি, বর্তমানে আমরা যেভাবে বহিঃবিভাগ সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করি তাতে আমরা রোগীদের আরো বেশি ক্ষতি করি। একই সাথে সরকারি ঔষধের নির্বিচারে অপব্যবহার করি যার এন্টিবায়োটিক রেজিস্টান্স এর মতো মারাত্নক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে ফেলেছে। চিকিৎসক নিজেও তার শ্রম, মেধা আর জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারছেন না। তিনিও শুধু আউটডোরে বসা ‘ওষুধ ডেলিভারি পারসন’ হয়ে যাচ্ছেন। এ ধরনের ওপিডি সিস্টেম স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও অর্থনীতির অন্য হুমকি।

রেলের টিকেট টাও এখন এনআইডি দিয়ে অনলাইনে কাটতে হয়। তাই পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ফার্মসী সার্ভিসও প্রযুক্তিনির্ভর করার কোন বিকল্প নাই। নাহলে রোগীদের সাথে সিস্টেমের এই ‘প্রতারণা’ চলতেই থাকবে।