ঢাকা ১২:৫৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অগ্ন্যাশয় এর জটিল জীবনঘাতি রোগঃ প্যানক্রিয়াটাইটিস

ডাঃ রাজীব দে সরকার
  • আপডেট সময় : ০৬:৪৭:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ৭৯ বার পড়া হয়েছে

আজ থেকে ১০ বছর আগেও যখন হাসপাতাল গুলোতে রোগী দেখা হতো, তখনও প্যানক্রিয়াটাইটিস এর মতো রাশভারী গোছের রোগের নাম তেমন একটা শোনা যেতো না। দিন বদলেছে। মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও বেড়েছে স্বাস্থ্য সচেতনতা। ক্রনিক ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। কিন্তু সেই সাথে আজ যে রোগটা নিয়ে আজ লিখছি, সেই রোগের নামটাও দিনকে দিন যুক্ত হচ্ছে হাসপাতালের ভর্তি রোগীর তালিকায়।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বার, সবখানেই ইদানিং প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে এবং বাড়ছে। আর এই বাড়াটা বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণেই।

প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় মানবদেহের প্রচন্ড গুরুত্বপূর্ণ এবং ততোধিক সেন্সিটিভ একটি অঙ্গ। পেটের ভেতরে মাঝ বরাবর পেছনের দিকে থাকে এই অঙ্গটি। একে ‘রেট্রোপেরিটনিয়াল অর্গান’ বলা হয়। সংজ্ঞা অনুযায়ী, প্যানক্রিয়াটাইটিস হলো এই অগ্ন্যাশয় এর প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন। তবে যতো সহজে এই সংজ্ঞা শেষ করলাম, রোগটির বিস্তার বা রোগ-প্রণালী এবং তৎসংশ্লিষ্ট জটিলতা ততোধিক কঠিন ও দুরারোগ্য। রোগটি কখনো কখনো জীবনঘাতীও হতে পারে। রোগের চিকিৎসায় প্রাথমিক পর্যায়েই রোগীকে আইসিইউতে স্থানান্তর এর প্রয়োজন হতে পারে।

রোগটি সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। অগ্ন্যাশয়ের এই প্রদাহ দুই ধরণের। ‘অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস’ এবং ‘ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস’। দুই ধরণের মধ্যে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। তবে রোগের আঙ্গিক অনেকটাই কাছাকাছি।

এই রোগের লক্ষণগুলো হলোঃ (১) প্রচন্ড পেটে ব্যাথা। ব্যথা এতোটাই প্রকট হতে পারে যে সচরাচর ব্যবহৃত পেইন কিলারে এই ব্যথা কমতে চায় না। রোগীকে তখন হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পরে। প্যানক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত রোগীর বার বার হাসপাতালে ভর্তির হিস্ট্রি পাই আমরা। (২) অনেক পরিমাণে বমি বা বমি বমি ভাব। (৩) উচ্চ তাপমাত্রাসহ জ্বর। পরবর্তী পর্যায়ে প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত রোগীর (৪) শ্বাসকষ্ট (৫) পেট ফুলে যাওয়া সহ অন্যান্য লক্ষণও দেখা দিতে পারে।

প্যানক্রিয়াটাইটিস হওয়ার কারন আলোচনা করতে গেলে যে কারন গুলোর কথা অবশ্যই বলতে হবে তা হলোঃ (১) পিত্তথলীর পাথর (২) অ্যালকোহল পান করা (৩) ইআরসিপি-পরবর্তী সময়ে (৪) পেটে আঘাত লাগা (৫) মেজর কোন সার্জারির পরে (৬) পেরি অ্যাম্পুলারি ক্যান্সার ইত্যাদি। এছাড়া আরো বেশ কিছু কারনেও প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগটি হতে পারে। আবার অনেক সময় এমনও হতে পারে প্যানক্রিয়াটাইটিস কেন হলো, সেই কারনটি হয়তো খুঁজেও পাওয়া যাবে না।

সাধারণতঃ রক্তের উপাদান (এনজাইম) সেরাম অ্যামাইলেজ এবং সেরাম লাইপেজ পরীক্ষা করে রোগটি ধরা সম্ভব। একই সাথে একটি পেটের আলট্রাসনোগ্রাম বা সিটিস্ক্যান এর মাধ্যমেও প্যানক্রিয়াটাইটিস সনাক্ত করা সম্ভব।

আরো একটি বিশেষ ধরণের প্যানক্রিয়াটাইটিস এর কথা ইদানিং আলোচনায় এসেছে এবং এই বিশেষ ধরণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। ধরণটির নাম ট্রপিক্যাল প্যানক্রিয়াটাইটিস। কিছু ধরণের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ আহার করলে এই ধরণের প্যানক্রিয়াটাইটিস বেশি হয়। তবে এই ধরণটি নিয়ে গবেষণা চলমান আছে।

অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস দুই প্রকারের হতে। (ক) ‘অ্যাকিউট ইডিমেটাস প্যানক্রিয়াটাইটিস’ (খ) ‘অ্যাকিউট নেক্রোটাইজিং প্যানক্রিয়াটাইটিস’। পরের ধরণটিতে মৃত্যুঝুঁকি আছে। প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগের তীব্রতার ধরণ বোঝার জন্য চিকিৎসকেরা একে মাইল্ড প্যানক্রিয়াটাইটিস, মডারেটলি সিভিয়ার প্যানক্রিয়াটাইটিস এবং অ্যাকিউট সিভিয়ার প্যানক্রিয়াটাইটিস এই ৩ ভাগে ভাগ করেন।

ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস এর রোগীর ওজন অনেক কম থাকে। অপুষ্টি থেকেও এই ধরণের প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে। এ ধরণের রোগীদের ডায়াবেটিস রোগ থাকে, কারন দীর্ঘদিন অগ্ন্যাশয় তার কাজ ঠিকমতো করতে পারে না।

একজন জেনারেল সার্জারী বিশেষজ্ঞ হিসেবে এ কথা সুস্পষ্ট করেই বলতে পারি, আগের যে কোন সময় থেকেই এখন প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক অনেক বেশী। এই রোগীরা যেমন সরকারী হাসপাতালের আউটডোরে সেবা নিচ্ছেন, আবার আমাদের প্রাইভেট চেম্বারেও আসছেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারী বিভাগের প্রতিদিনের অ্যাডমিশন রুমে ১-২ জন প্যানক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। ২০২১ সালের এই হাসপাতালের সার্জারী বিভাগে ৩২০ জন রোগী ভর্তি হয়েছিলো। আমি ফেব্রুয়ারী ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারী ২০২২ পর্যন্ত সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে ৫৭ জন প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগীর চিকিৎসা সেবায় জড়িত ছিলাম। এই রোগীদের মধ্যে ৩২ জন অ্যাকিউট কেসে আক্রান্ত ছিলেন (৫৬.১%)। এর মধ্যে ১৭ জন রোগী (২৯.৮%) সার্জারির প্রয়োজন পরে। বাকি ৪০ জন রোগীকে (৭০.১%) কনজারভেটিভ চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিলো।

বাংলাদেশের কোভিড পরবর্তী সময়ে এই ধরণের পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। একজন চিকিৎসক হিসেবে এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের জীবন যাপন সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত একজন মানুষের দৈনন্দিন যাপিত জীবনে বেশ বড় সড় পরিবর্তন আসে। শঙ্কা আর হতাশা আচ্ছন্ন করে ফেলে তার পুরো পরিবারকে। একটি রোগ একজন রোগীর পরিবারকে বিধ্বস্ত করে দিতে পারে এবং দিচ্ছেও।

আমাদের হাসপাতালে যে ধরণের রোগী আমরা পেয়েছি তাদের মধ্যে পিত্তথলীর পাথর, ইআরসিপি করা রোগীই বেশি ছিলো। অর্থাৎ রোগের কারন উদ্ঘাটনে আমরা সফল ছিলাম। কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত অনেকেই সঠিক চিকিৎসা নিচ্ছেন না বা অপচিকিৎসা, ঝাঁড়ফুক বা কবিরাজী চিকিৎসা নিচ্ছেন, এমন তথ্যও আমাদের কাছে আছে। ফলে রোগীরা অনেক সময়ই অনেক জটিল অবস্থায় আমাদের কাছে এসে হাজির হন। ফলে তার ভোগান্তি বাড়ে। চিকিৎসা ব্যয় বাড়ে। মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। একটি পরিবার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরে।

বিস্ময়কর হলেও সত্য অন্যান্য অ্যাকিউট বা ক্রনিক রোগের মতো প্যানক্রিয়াটাইটিস নিয়ে শিক্ষিত জনগণের মধ্যেও জানাশোনা বেশ কম। একইভাবে মিডিয়াতেও এই জীবনঘাতি রোগ নিয়ে তেমন কোন তোলপাড় নেই। অথচ এই রোগ ধীরে ধিরে আমাদের স্বাস্থ্যখাতে, স্বাস্থ্যবাজেটে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিতে একটি বড় অংশ দখল করতে শুরু করেছে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের দুরাবস্থা অনেক সময় ভাষায় প্রকাশ করার মতো থাকে না। তাই এই রোগ নিয়ে সকল মহলেই সচেতনতা বৃদ্ধি ভীষণভাবে জরুরী। প্রচন্ড সেন্সিটিভ এই অঙ্গের প্রতি আমাদেরও সেন্সিটিভ হবার সময়ে এসেছে।

ডাঃ রাজীব দে সরকার, সার্জারী বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট


লেখকঃ
ডাঃ রাজীব দে সরকার, 
সার্জারী বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা।
চেম্বারঃ DMFR মলিকিউলার ল্যাব, ধানমন্ডী ২৭, ঢাকা। মোবাইলঃ ০১৭১১-১৯৪৮৫১
ট্যাগস : Rajbaribd.com

নিউজটি শেয়ার করুন

অগ্ন্যাশয় এর জটিল জীবনঘাতি রোগঃ প্যানক্রিয়াটাইটিস

আপডেট সময় : ০৬:৪৭:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আজ থেকে ১০ বছর আগেও যখন হাসপাতাল গুলোতে রোগী দেখা হতো, তখনও প্যানক্রিয়াটাইটিস এর মতো রাশভারী গোছের রোগের নাম তেমন একটা শোনা যেতো না। দিন বদলেছে। মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও বেড়েছে স্বাস্থ্য সচেতনতা। ক্রনিক ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। কিন্তু সেই সাথে আজ যে রোগটা নিয়ে আজ লিখছি, সেই রোগের নামটাও দিনকে দিন যুক্ত হচ্ছে হাসপাতালের ভর্তি রোগীর তালিকায়।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বার, সবখানেই ইদানিং প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে এবং বাড়ছে। আর এই বাড়াটা বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণেই।

প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় মানবদেহের প্রচন্ড গুরুত্বপূর্ণ এবং ততোধিক সেন্সিটিভ একটি অঙ্গ। পেটের ভেতরে মাঝ বরাবর পেছনের দিকে থাকে এই অঙ্গটি। একে ‘রেট্রোপেরিটনিয়াল অর্গান’ বলা হয়। সংজ্ঞা অনুযায়ী, প্যানক্রিয়াটাইটিস হলো এই অগ্ন্যাশয় এর প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন। তবে যতো সহজে এই সংজ্ঞা শেষ করলাম, রোগটির বিস্তার বা রোগ-প্রণালী এবং তৎসংশ্লিষ্ট জটিলতা ততোধিক কঠিন ও দুরারোগ্য। রোগটি কখনো কখনো জীবনঘাতীও হতে পারে। রোগের চিকিৎসায় প্রাথমিক পর্যায়েই রোগীকে আইসিইউতে স্থানান্তর এর প্রয়োজন হতে পারে।

রোগটি সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। অগ্ন্যাশয়ের এই প্রদাহ দুই ধরণের। ‘অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস’ এবং ‘ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস’। দুই ধরণের মধ্যে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। তবে রোগের আঙ্গিক অনেকটাই কাছাকাছি।

এই রোগের লক্ষণগুলো হলোঃ (১) প্রচন্ড পেটে ব্যাথা। ব্যথা এতোটাই প্রকট হতে পারে যে সচরাচর ব্যবহৃত পেইন কিলারে এই ব্যথা কমতে চায় না। রোগীকে তখন হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পরে। প্যানক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত রোগীর বার বার হাসপাতালে ভর্তির হিস্ট্রি পাই আমরা। (২) অনেক পরিমাণে বমি বা বমি বমি ভাব। (৩) উচ্চ তাপমাত্রাসহ জ্বর। পরবর্তী পর্যায়ে প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত রোগীর (৪) শ্বাসকষ্ট (৫) পেট ফুলে যাওয়া সহ অন্যান্য লক্ষণও দেখা দিতে পারে।

প্যানক্রিয়াটাইটিস হওয়ার কারন আলোচনা করতে গেলে যে কারন গুলোর কথা অবশ্যই বলতে হবে তা হলোঃ (১) পিত্তথলীর পাথর (২) অ্যালকোহল পান করা (৩) ইআরসিপি-পরবর্তী সময়ে (৪) পেটে আঘাত লাগা (৫) মেজর কোন সার্জারির পরে (৬) পেরি অ্যাম্পুলারি ক্যান্সার ইত্যাদি। এছাড়া আরো বেশ কিছু কারনেও প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগটি হতে পারে। আবার অনেক সময় এমনও হতে পারে প্যানক্রিয়াটাইটিস কেন হলো, সেই কারনটি হয়তো খুঁজেও পাওয়া যাবে না।

সাধারণতঃ রক্তের উপাদান (এনজাইম) সেরাম অ্যামাইলেজ এবং সেরাম লাইপেজ পরীক্ষা করে রোগটি ধরা সম্ভব। একই সাথে একটি পেটের আলট্রাসনোগ্রাম বা সিটিস্ক্যান এর মাধ্যমেও প্যানক্রিয়াটাইটিস সনাক্ত করা সম্ভব।

আরো একটি বিশেষ ধরণের প্যানক্রিয়াটাইটিস এর কথা ইদানিং আলোচনায় এসেছে এবং এই বিশেষ ধরণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। ধরণটির নাম ট্রপিক্যাল প্যানক্রিয়াটাইটিস। কিছু ধরণের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ আহার করলে এই ধরণের প্যানক্রিয়াটাইটিস বেশি হয়। তবে এই ধরণটি নিয়ে গবেষণা চলমান আছে।

অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস দুই প্রকারের হতে। (ক) ‘অ্যাকিউট ইডিমেটাস প্যানক্রিয়াটাইটিস’ (খ) ‘অ্যাকিউট নেক্রোটাইজিং প্যানক্রিয়াটাইটিস’। পরের ধরণটিতে মৃত্যুঝুঁকি আছে। প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগের তীব্রতার ধরণ বোঝার জন্য চিকিৎসকেরা একে মাইল্ড প্যানক্রিয়াটাইটিস, মডারেটলি সিভিয়ার প্যানক্রিয়াটাইটিস এবং অ্যাকিউট সিভিয়ার প্যানক্রিয়াটাইটিস এই ৩ ভাগে ভাগ করেন।

ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস এর রোগীর ওজন অনেক কম থাকে। অপুষ্টি থেকেও এই ধরণের প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে। এ ধরণের রোগীদের ডায়াবেটিস রোগ থাকে, কারন দীর্ঘদিন অগ্ন্যাশয় তার কাজ ঠিকমতো করতে পারে না।

একজন জেনারেল সার্জারী বিশেষজ্ঞ হিসেবে এ কথা সুস্পষ্ট করেই বলতে পারি, আগের যে কোন সময় থেকেই এখন প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক অনেক বেশী। এই রোগীরা যেমন সরকারী হাসপাতালের আউটডোরে সেবা নিচ্ছেন, আবার আমাদের প্রাইভেট চেম্বারেও আসছেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারী বিভাগের প্রতিদিনের অ্যাডমিশন রুমে ১-২ জন প্যানক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। ২০২১ সালের এই হাসপাতালের সার্জারী বিভাগে ৩২০ জন রোগী ভর্তি হয়েছিলো। আমি ফেব্রুয়ারী ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারী ২০২২ পর্যন্ত সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে ৫৭ জন প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগীর চিকিৎসা সেবায় জড়িত ছিলাম। এই রোগীদের মধ্যে ৩২ জন অ্যাকিউট কেসে আক্রান্ত ছিলেন (৫৬.১%)। এর মধ্যে ১৭ জন রোগী (২৯.৮%) সার্জারির প্রয়োজন পরে। বাকি ৪০ জন রোগীকে (৭০.১%) কনজারভেটিভ চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিলো।

বাংলাদেশের কোভিড পরবর্তী সময়ে এই ধরণের পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। একজন চিকিৎসক হিসেবে এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের জীবন যাপন সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত একজন মানুষের দৈনন্দিন যাপিত জীবনে বেশ বড় সড় পরিবর্তন আসে। শঙ্কা আর হতাশা আচ্ছন্ন করে ফেলে তার পুরো পরিবারকে। একটি রোগ একজন রোগীর পরিবারকে বিধ্বস্ত করে দিতে পারে এবং দিচ্ছেও।

আমাদের হাসপাতালে যে ধরণের রোগী আমরা পেয়েছি তাদের মধ্যে পিত্তথলীর পাথর, ইআরসিপি করা রোগীই বেশি ছিলো। অর্থাৎ রোগের কারন উদ্ঘাটনে আমরা সফল ছিলাম। কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত অনেকেই সঠিক চিকিৎসা নিচ্ছেন না বা অপচিকিৎসা, ঝাঁড়ফুক বা কবিরাজী চিকিৎসা নিচ্ছেন, এমন তথ্যও আমাদের কাছে আছে। ফলে রোগীরা অনেক সময়ই অনেক জটিল অবস্থায় আমাদের কাছে এসে হাজির হন। ফলে তার ভোগান্তি বাড়ে। চিকিৎসা ব্যয় বাড়ে। মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। একটি পরিবার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরে।

বিস্ময়কর হলেও সত্য অন্যান্য অ্যাকিউট বা ক্রনিক রোগের মতো প্যানক্রিয়াটাইটিস নিয়ে শিক্ষিত জনগণের মধ্যেও জানাশোনা বেশ কম। একইভাবে মিডিয়াতেও এই জীবনঘাতি রোগ নিয়ে তেমন কোন তোলপাড় নেই। অথচ এই রোগ ধীরে ধিরে আমাদের স্বাস্থ্যখাতে, স্বাস্থ্যবাজেটে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিতে একটি বড় অংশ দখল করতে শুরু করেছে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের দুরাবস্থা অনেক সময় ভাষায় প্রকাশ করার মতো থাকে না। তাই এই রোগ নিয়ে সকল মহলেই সচেতনতা বৃদ্ধি ভীষণভাবে জরুরী। প্রচন্ড সেন্সিটিভ এই অঙ্গের প্রতি আমাদেরও সেন্সিটিভ হবার সময়ে এসেছে।

ডাঃ রাজীব দে সরকার, সার্জারী বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট


লেখকঃ
ডাঃ রাজীব দে সরকার, 
সার্জারী বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা।
চেম্বারঃ DMFR মলিকিউলার ল্যাব, ধানমন্ডী ২৭, ঢাকা। মোবাইলঃ ০১৭১১-১৯৪৮৫১