স্টাফ রিপোর্টারঃ একের পর এক চিকিৎসক বদলী নিয়ে অন্য জেলার অন্য হাসপাতালে চলে যাওয়ায় রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে তৈরী হয়েছে তীব্র চিকিৎসক সংকট। কিছু বিভাগের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পরেছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট পদ আছে ১০ টি। দূর্ভাগ্য জনক হলো, এর মধ্যে ৮টি পদেই কোন চিকিৎসক এর পোস্টিং নাই। অর্থাৎ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ব্যবস্থা একদমই নড়বড়ে। ফলে রাজবাড়ী জেলা সদর ও এর ৪টি উপজেলার মানুষের জন্য সরকারী ভাবে বিশেষজ্ঞ সেবা নাই বললেই চলে। অথচ একটি হাসপাতালের ওয়ার্ড ও আউটডোর পূর্ণাঙ্গ ভাবে চালাতে গেলে এই সকল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকা আবশ্যিক।
জুনিয়র কনসালটেন্ট পদ আছে ১২ টি। এদের মধ্যে চিকিৎসক আছেন শুধু ৬টি তে। অর্থাৎ অর্ধেক জুনিয়র কনসালটেন্ট পদই ফাঁকা। ফলে ওয়ার্ডে রাউন্ড দেওয়া এবং নিয়মিত অপারেশন থিয়েটার পরিচালনা করে অপারেশন গুলো করাও সম্ভব হচ্ছে না।
দীর্ঘদিন ‘আবাসিক মেডিকেল অফিসার’ পদ শূন্য থাকলেও ২ মাস আগে ১ জন নারী আবাসিক মেডিকেল অফিসার যোগদান করেছেন। অন্যদিকে হাসপাতালের ‘প্যাথলজিস্ট’ এবং ‘রেডিওলজিস্ট’ এই ২টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে।
মোট মেডিকেল অফিসার এর পদ ১৬টি। তবে জরুরী বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন ৬ জন চিকিৎসক যা সংখ্যায় অনেক কম। ফলে চিকিৎসকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয় এবং ঘণতার পর ঘন্টা টানা দায়িত্ব পালন করতে হয়। এদের মধ্যেই কয়েকজন চিকিৎসককে নীচতলার আউটডোরে বসতে হয়। সেখানেই একেকটি কক্ষে প্রতিদিন ২০০ থেকে থেকে ৩০০ রোগীকে সেবা প্রদান করতে হয়।
একজন চিকিৎসক দায়িত্বরত সময় অসুস্থ বোধ করলেও চিকিৎসক স্বল্পতার কারণে তাকে তার ডিউটি পালন করে যেতে হয়। এরকম অতিরিক্ত ডিউটি সহ নানা কারণে রাজবাড়ী জেলা সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা এই হাসপাতাল থেকে অন্যত্র বদলী হচ্ছেন।
জানুয়ারী মাসে হাসপাতালের একমাত্র মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ শামীম আহসান বদলী হয়ে ঢাকার মহাখালির ডিএনসিসি হাসপাতালে চলে যান। সেই থেকে এই হাসপাতালে মেডিসিন এর কনসালটেন্ট পদ শূন্য রয়েছে। ফলে এই হাসপাতালে এখন কোন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ নাই।
মার্চ মাসেই ১৫ দিনের ব্যবধানে ২ জন চক্ষু বিশেষজ্ঞ (জুনিয়র কনসালটেন্ট) বদলী হন ঢাকায়। ফলে বন্ধ হয়ে এ হাসপাতালে চোখের ছানি অপারেশন সহ সকল প্রকার অপারেশন ও চক্ষু সেবা। রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল সেই থেকে অন্ধ।
গত জুন মাসে হাসপাতালের একমাত্র দন্ত চিকিৎসক ডাঃ কানিজ ফাতেমা বদলী হয়ে যান ঢাকায়। ফলে এই মুহুর্তে এই হাসপাতালে দন্ত সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ আছে। ডেন্টাল আউটডোরে একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কে বসে থাকতে দেখা গেছে।
এদিকে চিকিৎসক সংকট শুরু হওয়া মাত্রই বৈকালিক সেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দুপুরের পরে সকল অপারেশন, বিশেষজ্ঞদের রোগী দেখা, এক্সরে ও রক্ত পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়।
১০০ বেডের হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও এখানে গড়ে ১২০-১৭০ জন পর্যন্ত রোগী ভর্তি থাকেন। এই বিশাল রোগীকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য কর্মচারীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক ও নার্স আমাদেরকে জানিয়েছেন, রাজবাড়ী জেলা সদর হাসপাতালে কাজের ও রোগীর চাপ অনেক বেশী। টানা ডিউটি করে শারীরিকভাবে অনেকে অসুস্থ হয়ে গেলেও ডিউটি করে যেতে হয়।
চিকিৎসকদের চলে যাওয়া আরেকটি বড় কারণ, এখানকার ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের মালিক, ডায়াগনোস্টিক এর দালাল এবং হাসপাতাল এলাকার ফার্মেসী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ন্য। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এরা নিয়মিতই হাসপাতাল থেকে রোগীদেরকে নিয়ে তাদের ল্যাবে টেস্ট করান।
হাসপাতাল এলাকার অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক ল্যাবের রিপোর্টের মান ভালো নিম্নমানের এবং রিপোর্ট এর তথ্য রোগীর লক্ষণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। এসব নিয়ে কয়েকজন সিনিয়র চিকিৎসক কয়েকবার প্রতিবাদ জানালে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সব দালালেরা সংঘবদ্ধভাবে তাদের নামে কুৎসা রটাতে থাকেন। ফলে সম্মান হারানোর ভয়ে চিকিৎসকদের বদলি নেওয়া ছাড়া আর করণীয় কিছু থাকে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজবাড়ী শহরে রাত ১.০০ টার পরে কোন ফার্মেসীর দোকান খোলা থাকে না। ফলে একজন মুমূর্ষু রোগীর সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরাও বিপদে পরেন। শত ভাগ ঔষধ সরবরাহ যেহেতু কোন হাসপাতালেই সম্ভব না তাই রাতের বেলা ফার্মেসী গুলো বন্ধ থাকায় রোগীর স্বজনদের রোষানলে পরেন চিকিৎসকেরা। আবার রোগীর জীবন বাঁচাতে রোগীকে অন্যত্র রেফার করলেও এর দোষ চিকিৎসকের ঘাড়েই পরে। আর অন্যদিকে ফার্মেসী ব্যবসায়ীগণ অধিক মুনাফার আশায় চিকিৎসকদের লিখে দেওয়া প্রেসক্রিপশনের ওষুধ রোগীকে না দিয়ে নিম্ন মানের কোম্পানির ওষুধ বিক্রী করেন। এসব নিয়েও এক সময় চিকিৎসকরা প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু উলটো তাদের বিরুদ্ধেই হাসপাতাল এলাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয় যে তারাই গণশত্রুতে পরিণত হন। এরকম বহুবিধ কারণে রাজবাড়ী জেলা সদর হাসপাতাল থেকে একে একে চলে যাচ্ছেন সিনিয়র ও জুনিয়র চিকিৎসকেরা।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল হান্নানের এর সাথে যোগাযোগ করা হলে চিকিৎসক সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, “কনসালট্যান্ট চিকিৎসকের বেশ কয়েকটি পদ ফাঁকা। এর মধ্যে চক্ষু ও মেডিসিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চক্ষু কনসালট্যান্ট না থাকায় ছানি অপারেশন করা যাচ্ছে না। সাধারণ সেবাও তারা দিতে পারছেন না। চক্ষু কনসালট্যান্ট যখন ছিলেন, তখন মাসে দেড়শ রোগীর অপারেশন হতো। জরুরি বিভাগে আলাদা কোনো পোস্ট নেই। বহির্বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করেন। এত অল্প চিকিৎসক দিয়ে দুটি বিভাগ সামলানো যাচ্ছে না।”
বহির্বিভাগে বিপুলসংখ্যক রোগী দেখতে হিমশিম খেতে হয় জানিয়ে সহকারী সার্জন ডা. ওমর ফারুক বলেন, “একজন রোগী দেখতে অন্তত পাঁচ মিনিট দরকার। অথচ এখানে ৩০-৪০ সেকেন্ড মাত্র সময় পাওয়া যায়। কোনোমতে রোগীর কাছে শুনেই প্রেসক্রিপশন লিখতে হয়। যে কারণে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। অতি চাপের কারণে কোনো চিকিৎসক রাজবাড়ী হাসপাতালে আসতে চান না। এলেও চলে যান।”
সর্বশেষ চলতি জুলাই মাসে মেডিকেল অফিসার ডাঃ আমিরুজ্জামান এবং মেডিকেল অফিসার ডাঃ আশরাফ হোসেন বদলী হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
বিদ্যমান সমস্যা গুলো সমাধান করা না হলে রাজবাড়ী জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসকরা বেশিদিন কাজ করতে আগ্রহী হবেন না বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ১২ লাখ মানুষের এই জনপদ।
মন্তব্য করুন