রাজবাড়ীর সড়ক দূর্ঘটনা ও মহাসড়কের 'মৃত্যুদূত' অটোরিক্সা - Rajbari
রাজবাড়ী বিডি ডেস্ক
২১ জুন ২০২৫, ৭:৫৩ অপরাহ্ন
অনলাইন সংস্করণ

রাজবাড়ীর সড়ক দূর্ঘটনা ও মহাসড়কের ‘মৃত্যুদূত’ অটোরিক্সা

সড়ক দূর্ঘটনায় রাজবাড়ী জেলার নাম বেশ প্রথম দিকে আসবে। কারন একদিকে ঐতিহ্যবাহী দৌলৎদিয়া ঘাট থাকার কারনে এই জেলা বহু জেলায় যাতায়াতের মূল সংযোগ স্থান, অন্যদিকে ‘মহাসড়কে’ সড়কে থ্রী-হুইলার, ভ্যান, রিক্সা, অটোরিক্সা এদের অনিয়ন্ত্রিত দাপট এই জেলার মহাসড়ককে সড়ক দূর্ঘটনার রামরাজত্বে পরিণত করেছে।

গত ঈদুল আযহার ছুটিকালীন সময়ে রাজবাড়ী জেলা সদর হাসপাতালে সড়ক দূর্ঘটনার শতাধিক কেস লিপিবদ্ধ হয়েছে যা সাধারণ মানুষ অনেকেই জানেন না।

সড়ক দূর্ঘটনার হিসাব না হয় বললাম। কিন্তু রাজবাড়ী জেলার মহাসড়কে যে কি পরিমাণে তিন-চাকা বিশিষ্ট ব্যাটারিচালিত অবৈধ যানবাহন চলে, তার সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারবে না। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, রাজবাড়ী  জেলার মহাসড়কে সড়ক দূর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ ব্যাটারিচালিত এই সব ভ্যান-অটো, মাহিন্দ্র এবং নসিমন বাহন। যারা অ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে আসেন তার ভাষ্য থেকেই এই লেখা লিখছি।

কোন আইনেই দেশীয় প্রযুক্তির এই সব বাহন সড়কে বা মহাসড়কে চলতে পারে না। আর মহাসড়কে বা হাই-ওয়েতে থ্রী-হুইলার চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইন আমরা সবাই-ই জানি, কিন্তু তারপরো এসব মানি না। তাই প্রতিনিয়ত সড়ক দূর্ঘটনায় নিজের ও আপন জনের বড় বড় ক্ষতি করে ফেলি।

ব্যাটারি চালিত রিক্সা আর ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা দু’টোতেই আমি চড়েছি।

আমি একদিন নিজে GPS Speedometer App দিয়ে এই দুইটি বাহনেরই স্পীড চেক করছিলাম। অটো-রিক্সাতে সর্বোচ্চ স্পীড পেয়েছিলাম ৩২ কিঃমিঃ/ঘন্টা আর ব্যাটারি চালিত রিক্সা সর্বোচ্চ স্পীড উঠেছিলো ৩৮ কিঃমিঃ/ঘন্টা।
আমার কিছু অবজারভেশন বলিঃ

১। অটোরিক্সা বা ব্যাটারি চালিত রিক্সা যারা চালান তাদের অধিকাংশেরই সড়কের Lane কি জিনিস এই বিষয়ে ধারণা নাই। একই সড়কে যে একাধিক লেন থাকে এবং একটি লেন থেকে অন্য একটি লেনে যেতে হলে সিগনাল দিতে হয়, সে বিষয়ে তাদের কোন ধারণা নেই। আমি নিজে কয়েকজনের সাথে কথা বলে বুঝেছি, সড়কে লেন কি জিনিস সে বিষয়ে তারা ধারণা রাখেন না এবং ধারণা রাখার প্রয়োজনও মনে করেন না।

২। স্পীড কোন সমস্যা হতো না যদি তাদের Braking System একই মাত্রায় উন্নত হতো। সত্যি কথা বলতে কি, প্যাডেল রিক্সায় শুধু ব্যাটারি বসানোটাই হলো এই বাহনগুলোর মূল টেকনোলজি। এজন্য ব্রেকিং সিস্টেম সেই পুরো হাতে-চাপা ব্রেকই থেকে গেছে। ফলে মনের আনন্দে ৩৫-৩৮ কি”মিঃ/ঘন্টা ওঠানো হয়তো যায়, কিন্তু প্রয়োজনের সময় নির্ভরযোগ্য ব্রেক এই রিক্সা গুলোর নাই। ফলে স্পীড তোলার পরে স্পীড নিয়ন্ত্রণ করা এই বাহন গুলো পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলাফলঃ দূর্ঘটনা।

৩। যেহেতু স্পীড লিমিটের দিক দিয়ে তাকালে এরা গাড়ি বা মোটরসাইকেল এর লেভেলেই চলে এসেছে। কারণ শহরের ভিতরে গাড়ি বা মোটরসাইকেল গুলো ৪০-৫০ কিঃমিঃ/ঘন্টা এই রেঞ্জের মধ্যেই চলাচল করে। কিন্তু মোটর সাইকেল বা গাড়ির প্রযুক্তিগত যে মান বা ড্রাইভিং ব্যালেন্স এর স্ট্যাটাস, এই অটোরিক্সা বা ব্যাটারি চালিত রিক্সার সেটি নাই। আবার মোটরসাইকেল আরোহীর মতো রিক্সার আরোহী বা চালক কেউ-ই হেলমেট বা কোন সেফটি গিয়ারও ব্যবহার করে না। ফলাফলঃ দূর্ঘটনা এবং তা মাআত্নক দূর্ঘটনা।

৪। অটোরিক্সা বা প্যাডেল চালিত রিক্সার চালকদের প্রশিক্ষণ দেবারও কোন সুযোগ নেই। কারন (ক) এদের সংখ্যা অগণিত (খ) এরা কোনদিন এ বিষয়ে আগ্রহী হবে না (গ) প্রচলিত আইনে এদের অপরাধের দন্ড দেবার কোন সুযোগ নাই। [আমি জেনেই বলছি, “সড়ক পরিবহণ আইন, ২০১৮” দেখতে পারেন। দেশীয় কারিগর দিয়ে বানানো এই যানবাহন দুটোই অবৈধ, তাই একজন কর্তব্যরত পুলিশ কেবল বাহনটি ডাম্পিং বা জব্দ করতে পারেন। তাও শুধু মেট্রোপলিটন এলাকাতেই আপনি এই দন্ডের প্রয়োগ দেখবেন। ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহরের বাইরে গেলেই আর ডাম্পিং এর সুযোগ নাই/অপ্রতুল। আর ডাম্পিং এর কথা আসলেই কিন্তু এদেশে ভিকটিম-কার্ডের মুখোমুখি হবেন, অর্থাৎ চালক “গরীব”, তাই তার অপরাধ, “অপরাধ নয়”।

৫। প্যাডেল চালিত রিক্সায় অতি দ্রুত স্পীড তুলে ফেলার বিষয়টি নাই এবং একই কারণে হুঠাট যে কোন দিকে টার্ন নেবার ক্যালিবারও এই বাহনবটির নাই। যেহেতু উচ্চগতি নাই, তাই বেশ কিছুদিন চালানোর পরে ধীরে ধীরে দক্ষতা আসে এই বাহন চালানোর। চাইলেই আপনি অন্য কোন বাহনের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে পারবেন না। তাই সড়কে বা মহাসড়কে এই বাহনটি অতোটা অ্যাগ্রেসিভ আচরণ করে না। কিন্তু একটি মধ্যম গতির বাহন হওয়াতে সড়কে নয় শুধু, হাইওয়েতেও অটোরিক্সা, ব্যাটারি চালিত রিক্সা এবং ব্যাটারি চালিত ভ্যান এর চালকেরা প্রচন্ড প্রতিযোগিতামূলক আচরণ করে গাড়ি চালায়। মহাসড়কেও এরা একে অন্যকে ওভারটেক করে। পিছনে অনেক দ্রুত গটির বড় গাড়ি (বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার) থাকলেও তারা নিজদের ওভারটেক কার্যক্রম সমাপ্ত করে তারপর অন্য বাহনকে সাইড দেয়। এই অহেতুক আত্নবিশ্বাস এর ফলাফল দূর্ঘটনা। এই দূর্ঘটনা গুলো জীবনঘাতি হয় এবং অঙ্গহানি ঘটায়।

৬। এই বাহনগুলো অর্থাৎ অটোরিক্সা ও ব্যাটারি চালিত রিক্সা গুলো অস্বাভাবিক স্পীড অর্জনের পর এদের ওজন এর ভারসাম্য নষ্ট হয়। দ্রুত গতিতে থাকার সময় এদের বাহনের আরোহীদের ওজনের কারণে বাহনটির ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। যেহেতু ব্যাটারিচালিত, তাই ইচ্ছামতো সীট সংখ্যাও বাড়ানো যায়। কারণ নির্মাতা মনে করেন যে শক্তি যেহেতু ব্যাটারি থেকে আসবে তাই সীট বাড়ালেও সেটা বহন করার ক্ষমতা বাহনটির থাকবে। বিপত্তিটা এখানে। প্রচণ্ড দুর্বল ব্রেক সিস্টেম এবং ব্যালেন্স এর ঘাটতির সাথে অতিরিক্ত ওজন বহন করার ফলে চালকের আসলে রিক্সার উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। নিয়ন্ত্রণ যে নাই, এটা তিনি বোঝেনও না। কারণ অতিরিক্ত গতি তাকে অহেতুক আত্নবিশ্বাসী করে তোলে। ফলাফলঃ মারাত্নক দূর্ঘটনা।

৭। মহাসড়কে দ্রুতগতির অনেক গাড়ি যেমনঃ বাস ট্রাক প্রাইভেট কার চলাচল করে। আমি দেখেছি অনেক সময় এই সব ব্যাটারিচালিত বাহন গুলো তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে গতি বাড়ায়। যেহেতু ব্যাটারি লাগানর কারণে তার গতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, তারা মনে করেন তারা এই সব নিরাপদ প্রযুক্তির গাড়িকেও টেক্কা দিতে পারেন। এর পরিণাম হয় ভয়াবহ।

মহাসড়কে কেউ যখন এই থ্রী-হুইলার নিয়ে দূর্ঘটনার স্বীকার হন, তখন মৃত্যু বা সুনিশ্চিত অঙ্গহানির ঠেকানো যায় না। সেদিক দিয়ে প্রাইভেট কারে বসা বা বাস-ট্রাকে বসা মানুষোটি কিন্তু নিরাপদেই থাকেন। তখন দোষ হয়ে যায় বড় গাড়ির চালকটির। উপস্থিত জনতাও আসলে কার দোষ সেটি জানতে চান না।

কেউ মানুক বা না মানুক, ব্যাটারি চালিত এই রিক্সাটি মোটেও “বৈধ” কোন বাহন না। সড়কে বা মহাসড়কে চলার কোন অনুমতি এটির নাই। দরিদ্র মানুষ পেশা হিসেবে একে গ্রহণ করেছেন বলে গ্রামে গঞ্জে বা অলিতে-গলিতে এই বাহন গুলো মানবিক কারণে চালানোর অনুমতি দেওয়া যেতে পারে (সেটিরও আইনগত ভিত্তি নাই), কিন্তু তাই বলে মূল সড়কে বা মহাসড়কে এদেরকে ঠাঁই দিলে সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা থাকবে না। অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অজস্র দূর্ঘটনাই এর প্রমাণ।

গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আর রাজবাড়ী জেলা সদর হাসপাতালে আনা ডেড-বডিগুলোর একটি বড় অংশই এই মহাসড়কের সড়ক দূর্ঘটনার।

দেখুন, “দরিদ্র” বলে চালকের প্রতি আমাদের অনুগ্রহ থাকতে পারে, কিন্তু চালক দরিদ্র বলে একজনের জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকার এই বাহনগুলোকে দিয়ে দেওয়া কতোটুকু সমীচিন?।

দরিদ্র ব্যাক্তিটিও যেমন মানুষ, যিনি দরিদ্র নন, তিনিও মানুষ। এই দুই ধরনের মানুষেরই পরিবার আছে এবং দু’জনের পরিবারের মানুষই তাদের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকেন। এই মৃত্যুমিছিল অবশ্যই থামাতে হবে। প্রশাসনের একার কাজ নয় এটি। আজ থেকে আপনি আমি সকলেই যদি ঠিক করি, যেহেতু থ্রী-হুলারদের মহাসড়কে ওঠার নিয়ম নেই, আমরা কেউ থ্রী-হুইলারে মহাসড়কে উঠবো না। তাহলেই পালটে যেতে পারে পরিস্থিতি।

[পুণশ্চঃ আমি একজন সার্জারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। পেশাগত জীবনে শুধু এই ব্যাটারী চালিত বাহন কতো মানুষের অঙ্গহানি / জীবন-নাশ করেছে, আমার সেই অভিজ্ঞতা গভীরভাবে তিক্ত এবং বর্ণনাযোগ্য নয়।]

 

লেখকঃ
ডাঃ রাজীব দে সরকার
সার্জারী বিশেষজ্ঞ। শিশু রোগ চিকিৎসক ও ল্যাপারোস্কপিক সার্জন। কলামিস্ট।

Facebook Comments Box

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গোয়ালন্দে হাসপাতালে রোগীর চাপ, হিমশিম ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী

ঢাকা ও খুলনায় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাজবাড়ীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ

রাজবাড়ীতে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের কোটি টাকা আত্মসাৎ, গাজীপুর থেকে অভিযুক্ত মিটার রিডার গ্রেপ্তার

পাংশায় কলেজের ওয়াশরুমে ধর্ষনের অভিযোগে কলেজ ছাত্র গ্রেফতার

গোয়ালন্দে দোকানঘর দখল ও ১০ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুটের অভিযোগ

বাংলাদেশের বিদ্যমান ‘আদালত’ ব্যবস্থাঃ একজন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের ভাষ্যে

‘সংসদে সংরক্ষিত আসনের দাবি হিন্দু মহাজোটের’

আইন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত গেজেট বাতিলের দাবিতে রাজবাড়ীতে আইনজীবীদের মানববন্ধন

গোয়ালন্দে ফেন্সিডিলসহ দুই মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

গোয়ালন্দে অসহায় প্রতিবন্ধি মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন হলো ইউএনও’র সহযোগিতায়

১০

পাংশায় সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ ২৫ বাড়িতে হামলার অভিযোগ, গ্রেফতার-১

১১

রাজবাড়ীতে ৬ দফা দাবিতে স্বাস্থ্য সহকারীদের অবস্থান কর্মসূচি

১২

রাজবাড়ী সরকারি কলেজে উপাধ্যক্ষের পদায়ন বা‌তিল চে‌য়ে শিক্ষার্থী‌দের স্মারক‌লি‌পি পেশ

১৩

রাজবাড়ী‌তে তা‌জিয়া মি‌ছি‌লে হাজার হাজার হুসাইন অনুসারী 

১৪

পবিত্র আশুরায় গোয়ালন্দে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে শোক মিছিল

১৫

‘নমিনেশন এখন তৃণমূল নেতাকর্মীদের হাতে’ -অ্যাড. আসলাম মিয়া

১৬

রাজবাড়ী‌তে ছাত্রদলের প্রী‌তি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত

১৭

ভাগ্নের হাতে মামা খুন   

১৮

গোয়ালন্দে গাঁজা, মোটরসাইকেল ও নগদ টাকাসহ চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার

১৯

কালুখালী‌তে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার ‌শিক্ষকের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন

২০